ব্যুরো নিউজ ১৭ জুন : মণিপুরে চলমান অস্থিরতার মধ্যে শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নিরাপত্তা বাহিনী একটি বড় সাফল্য অর্জন করেছে। শুক্রবার গভীর রাতে থেকে শনিবারের মধ্যে পরিচালিত এক যৌথ অভিযানে ইম্ফল উপত্যকার পাঁচটি জেলা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। এই অভিযান মণিপুরের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মণিপুরের অস্থিরতার সংক্ষিপ্তসার
মণিপুর গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতিগত সহিংসতায় জর্জরিত। ২০২৩ সালের ৩ মে মেতেই এবং কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। মেতেই সম্প্রদায়ের তফসিলি উপজাতি (ST) মর্যাদার দাবি এবং কুকি সম্প্রদায়ের এর বিরোধিতা এই সংঘাতের মূল কারণ। রাজ্য সরকার কর্তৃক মাদক চাষ এবং অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের কারণেও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। এই সহিংসতায় এ পর্যন্ত শত শত মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট এবং সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
সমন্বিত অভিযানে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার
সাম্প্রতিক অভিযানটি মণিপুর পুলিশ, কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী (CAPFs) এবং সেনাবাহিনীর সমন্বিত গোয়েন্দা-ভিত্তিক প্রচেষ্টার ফল। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে, ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, বিষ্ণুপুর, কাকচিং এবং থৌবাল জেলায় একযোগে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়।
উদ্ধারকৃত অস্ত্রের বিবরণ: এই অভিযানে মোট ৩২৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
- ১৫১টি সেলফ-লোডিং রাইফেল (SLRs)
- ৬৫টি ইনসাস রাইফেল
- ৭৩টি অন্যান্য অনির্দিষ্ট রাইফেল
- ৬টি একে সিরিজের রাইফেল
- ১২টি লাইট মেশিন গান (LMGs)
- ৫টি কার্বাইন
- ২টি এমপি৫ গান
- ২টি আমোগ রাইফেল
- ১টি মর্টার
- ৬টি পিস্তল
- ১টি এআর-১৫ রাইফেল
- ২টি ফ্লেয়ার গান
অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি, বাহিনী ৫৯১টি বিভিন্ন ম্যাগাজিন, ৩,৫৩৪টি এসএলআর রাউন্ড, ২,১৮৬টি ইনসাস রাউন্ড, ২,২৫২টি .৩০৩ রাইফেল রাউন্ড, ২৩৪টি একে রাউন্ড, ৪০৭টি আমোগ রাউন্ড, ২০টি ৯ মিমি পিস্তল রাউন্ড, ১০টি গ্রেনেড, ৩টি লাথোড এবং ৭টি ডেটোনেটর জব্দ করেছে।
শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা
কর্তৃপক্ষ এই অভিযানকে সংঘাত-কবলিত রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চলমান প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার সাথে নিবিড় সমন্বয় বজায় রাখছেন যাতে এই ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত এবং লক্ষ্যভিত্তিক উপায়ে চালানো যায়। পুলিশ শান্তিপূর্ণ মণিপুর বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং জনগণকে এই প্রচেষ্টায় সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছে। নাগরিকদেরকে যেকোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ বা অবৈধ অস্ত্র সম্পর্কিত তথ্য নিকটস্থ থানায় বা সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
৮ থেকে ১৫ জুনের অভিযান: ধারাবাহিক সাফল্যের ধারা
ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আসাম রাইফেলস, মণিপুর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ৮ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত মণিপুরের বিভিন্ন জেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সমন্বিত গোয়েন্দা-ভিত্তিক অভিযান চালায়।
এই অভিযানগুলি পাহাড় এবং উপত্যকা উভয় জেলাতেই পরিচালিত হয়েছিল — যার মধ্যে থৌবাল, চুরাচাঁদপুর, কাকচিং, তেংনোপাল, ইম্ফল পূর্ব এবং ইম্ফল পশ্চিম অন্তর্ভুক্ত — এবং এর ফলস্বরূপ চারজন ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২৩টি অস্ত্র, ১০টি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (IEDs), গ্রেনেড এবং বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধসদৃশ সামগ্রী জব্দ করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ অভিযানগুলির বিবরণ:
- ৮ জুন: মিশন ভেং, মোরেহ (তেংনোপাল) তে আসাম রাইফেলস এবং বিএসএফ দুটি ইম্প্রোভাইজড মর্টার উদ্ধার করে।
- ১২ জুন: আসাম রাইফেলস এবং মণিপুর পুলিশের যৌথ দল থৌবালের ইকোপ পাত এলাকা থেকে একটি .৩০৩ রাইফেল এবং একটি ৯ মিমি পিস্তল সহ পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। একই দিনে, আরেকটি যৌথ দল চুরাচাঁদপুরের টি লামলাই এবং কুভান গ্রামের মধ্যবর্তী বন থেকে আরও চারটি অস্ত্র এবং গোলাবারুদ আবিষ্কার করে।
- পরবর্তী উদ্ধার: ইম্ফল পূর্বেও আরও উদ্ধার কাজ চালানো হয়, যেখানে চামফাই থেকে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়।
- ১৩ জুন: তেংনোপাল জেলায় পরিচালিত বাহিনী একটি ৯ মিমি কার্বাইন, দুটি পিস্তল এবং ১০টি আইইডি উদ্ধার করে।
- ১৪ জুন: কাকচিংয়ের চেইরেল খুনৌ এলাকায় একটি উল্লেখযোগ্য ভান্ডার উন্মোচিত হয়, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী, আসাম রাইফেলস এবং মণিপুর পুলিশ চারটি অস্ত্র, ছয় কিলোগ্রাম বিস্ফোরক, গ্রেনেড এবং আরও অনেক কিছু সম্বলিত একটি লুকানো ভান্ডার খুঁজে পায়। একই দিনে থায়ং হিল, ইম্ফল পূর্বে আরেকটি অভিযানে আরও দুটি রাইফেল এবং গোলাবারুদ জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত চার ব্যক্তি, বাজেয়াপ্ত অস্ত্র এবং বিস্ফোরক সহ মণিপুর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমারের চিন স্টেট অ্যাক্টরস এবং পরিস্থিতি
মণিপুরের অস্থিরতা এবং বিশেষ করে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানে প্রতিবেশী মিয়ানমারের ভূমিকা একটি বড় উদ্বেগের কারণ। মিয়ানমারের চিন স্টেট (পূর্বে চিন রাজ্য), যা ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত বরাবর অবস্থিত, সেখানে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। মায়ানমারের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল অঞ্চলের সান্নিধ্য এবং অরক্ষিত আন্তর্জাতিক সীমান্ত মণিপুরকে মাদক পাচার এবং অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য দুর্বল করে তুলেছে। এই অবৈধ কার্যকলাপগুলি এই অঞ্চলে সহিংসতা এবং সামাজিক অস্থিরতাকে ইন্ধন যোগায়।
চিন স্টেট অ্যাক্টরস (যেমন ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি – UWSA) এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি চীনের ইউনান প্রদেশ বা মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বন্দুক কারখানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে। এই অস্ত্রগুলি এরপর বিভিন্ন চোরাচালান রুটের মাধ্যমে মণিপুরে প্রবেশ করে, যা স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির হাতে পড়ে এবং সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তোলে। মাদক ব্যবসা, বিশেষ করে আফিম এবং হেরোইন, এই অস্ত্র চোরাচালানের সাথে জড়িত এবং এটি এই অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করছে। এই পরিস্থিতি মণিপুরে শান্তি ফেরানোর প্রচেষ্টায় একটি অতিরিক্ত জটিলতা যোগ করেছে, কারণ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অস্ত্রের পাশাপাশি বিদেশি অস্ত্রের প্রবাহও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিরাপত্তা বাহিনীর এই ধরনের অভিযানগুলো সীমান্ত পেরিয়ে আসা অস্ত্রের প্রবাহ বন্ধ করার এবং রাজ্যের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।