ব্যুরো নিউজ ১৬ অক্টোবর ২০২৫ : যখনই এই পৃথিবীতে ভারসাম্য নষ্ট হয়, যখন অবিচার লাগামছাড়া হয়ে যায় এবং ধর্ম ভুলে যাওয়া নীতিতে পরিণত হয়, ঠিক তখনই বিষ্ণু , অর্থাৎ রক্ষাকর্তা, আর দূরে থাকেন না। তিনি ফিরে আসেন। তবে প্রতিবার তিনি একই রূপে আসেন না। কখনও তিনি আসেন মাছ রূপে, কখনও বা আসেন যোদ্ধা বা শিক্ষকের রূপে। প্রতিটি সংকটের জন্য তিনি বেছে নেন একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যপূর্ণ রূপ। বিষ্ণুর এই বহুবিধ রূপের ধারণা—যা দশাবতার নামে পরিচিত—কেবলমাত্র নিছক গল্প নয়। এটি একটি ঐশ্বরিক পরিকল্পনার প্রমাণ, যা দেখায় যে সত্য, ন্যায় ও করুণাকে আমাদের পরিবর্তিত উপলব্ধির সাথে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়।
‘অবতার’ শব্দের অর্থ: কেন বিষ্ণু বারবার ফিরে আসেন?
‘অবতার’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘অব’ (নীচে) এবং ‘তৃ’ (পার হওয়া বা নেমে আসা) ধাতু থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ হলো “নেমে আসা”। বিষ্ণুর অবতারেরা কোনো খেয়ালি শক্তি নন—প্রতিটি রূপই হলো নৈতিক ও মহাজাগতিক শৃঙ্খলার নির্দিষ্ট সংকটের প্রতি একটি উদ্দেশ্যমূলক, সময়োপযোগী এবং সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া। কেন এত বিভিন্ন রূপ? কারণ সত্যের চেহারা সবসময় একরকম হয় না। কখনও তাকে সাঁতার কাটতে হয়, কখনও তাকে কথা বলতে হয়, আবার কখনও তাকে যুদ্ধ করতে হয়।
সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ
কেন দশটি অবতার? একটি নয় কেন?
পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ঈশ্বরের একটি অবতার যথেষ্ট হতে পারে না। সময়ের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিষ্ণুর রূপ পরিবর্তিত হয়। তাঁর প্রথম অবতার ছিল মৎস্য রূপে, যখন কেবলমাত্র বেঁচে থাকাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। পরে তিনি রাম অর্থাৎ আদর্শ রাজা হিসাবে এসেছিলেন, যখন নেতৃত্বে নৈতিক স্পষ্টতা প্রয়োজন ছিল। এরপর এলেন কৃষ্ণ , যিনি ছিলেন এমন এক পথপ্রদর্শক, যিনি সঠিক ও ভুল অস্পষ্ট হয়ে গেলে, সেই ধূসর দিকটি উপলব্ধি করতে শেখান। প্রতিটি অবতার পৃথিবীকে তার বর্তমান অবস্থায় এসে উদ্ধার করেন, ঠিক যেমনটি আমরা চাই, তেমনটা নয়। এটাই এই ধারণাকে চিরন্তন করে তোলে।
দশাবতারে লুকানো বিবর্তন
বহু পণ্ডিত ও আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ একটি অসাধারণ বিষয় লক্ষ্য করেছেন: বিষ্ণুর অবতারের ক্রমটি পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনের সঙ্গে মিলে যায়।
- মৎস্য (মাছ): জীবনের শুরু জল থেকে।
- কূর্ম (কচ্ছপ): উভচর জীবন।
- বরাহ (শূকর): স্থলভাগের স্তন্যপায়ী।
- নৃসিংহ (অর্ধ-মনুষ্য, অর্ধ-সিংহ): পশু ও মানুষের মধ্যবর্তী পর্যায়।
- বামন (খর্বাকৃতি মানুষ): আদিম বুদ্ধিমান মানুষ।
- পরশুরাম: যন্ত্র, ক্রোধ ও শক্তিসম্পন্ন মানুষ।
- রাম: নৈতিক দিক থেকে আদর্শ মানুষ।
- কৃষ্ণ: কূটনৈতিক, ঐশ্বরিক কৌশলবিদ।
- বুদ্ধ: আধ্যাত্মিকভাবে জাগ্রত শিক্ষক।
- কল্কি (আসা বাকি): ভবিষ্যতের শোধনকারী, যিনি ধর্মকে পুনরুদ্ধার করবেন।
কেন অবতারের রূপ পরিবর্তিত হয়?
বিষ্ণুর এই রূপান্তরগুলি দ্বিধার লক্ষণ নয়। এগুলি হলো সংবেদনশীলতার লক্ষণ। ধর্ম সব যুগে একই রকম দেখতে হয় না। কিছু যুগে চরম শক্তির প্রয়োজন হয়, আবার কিছু যুগে নীরব শিক্ষার। বার্তাটির জন্য রূপটি অপরিহার্য। এটিই হলো সনাতন ধর্মের মূলকথা: এটি চিরন্তন, তবুও পরিবর্তনশীল। ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ অতীতকে পুনরাবৃত্তি করার জন্য নয়—এটি বর্তমানের প্রতি সাড়া দেওয়ার জন্য।
আসন্ন অবতার: কল্কি
কিছু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে যে একটি অবতারের রূপ নেওয়া এখনো বাকি: কল্কি , যিনি অধর্মের বিনাশকারী। তিনি বর্তমান যুগ, কলিযুগের শেষে আবির্ভূত হবেন, যখন মিথ্যা, লোভ ও বিভ্রান্তি চরম আকার ধারণ করবে। তিনি শাস্তি দিতে আসবেন না, বরং শুদ্ধি করতে আসবেন—চক্রটিকে নতুন করে শুরু করতে এবং জ্ঞানের পুনরুত্থান ঘটাতে। প্রতীকী হোক বা সত্য, কল্কি আমাদের নিজেদের সঙ্গেই আমাদের চূড়ান্ত সংঘর্ষের ইঙ্গিত দেন। এটি এক স্মারক যে সত্যকে হয়তো বিলম্বিত করা যায়, কিন্তু তা কখনও ধ্বংস করা যায় না।
Bhagavad Gita : গীতার শিক্ষায় , ভুল বোঝাবুঝির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি
অবতার আপনার ভেতরেই রয়েছে
বিষ্ণু কেন বারবার ফিরে আসেন? কারণ আমরা বারবার ভুলে যাই। আমরা করুণা ভুলে যাই, তাই তিনি কৃষ্ণ রূপে ফিরে আসেন। আমরা সরলতা ভুলে যাই, তাই তিনি বুদ্ধ রূপে আসেন। আমরা ভারসাম্য ভুলে যাই, তাই তিনি কল্কি রূপে আসার পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু গভীর সত্যটি হলো: প্রতিটি অবতার আমাদের মধ্যেই বাস করেন। নৃসিংহের শক্তি, রামের স্পষ্টতা, কৃষ্ণের জ্ঞান এবং বুদ্ধের নীরবতা—যখন আপনি আপনার মধ্যে এগুলিকে আহ্বান করেন, তখন আপনি আরও কিছুটা ঐশ্বরিক হয়ে ওঠেন। অবতারের আসার কারণ শুধু বিশ্বকে বাঁচানো নয়; এর কারণ হলো আপনার ভেতরের ঈশ্বরকে জাগ্রত করা।