ব্যুরো নিউজ ১৫ অক্টোবর ২০২৫ : ভারতীয় পৌরাণিক গাথাগুলিতে জ্ঞান, ভক্তি এবং হাস্যরসের এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। দেবাদিদেব মহাদেবের পুত্র শ্রী গণেশ এবং দেবকোষাধ্যক্ষ কুবেরের কাহিনিটি সেই শাশ্বত সত্যকে তুলে ধরে— যেখানে বস্তুগত সম্পদের উপর অহঙ্কার সর্বদা ঐশ্বরিক খেলার কাছে নতি স্বীকার করে। এই মনোহর আখ্যান আমাদের শেখায়: প্রকৃত ঐশ্বর্য সম্পদে নয়, বিনয় ও ভক্তিতে নিহিত।
কুবের: সম্পদের গর্বিত অধিপতি
দেবতাদের কোষাধ্যক্ষ এবং অলকাপুরীর শাসক কুবের ছিলেন অপরিসীম ধনী। তাঁর ভান্ডার ছিল সোনা, মণি-মুক্তা এবং স্বর্গীয় সম্পদে পূর্ণ। এই বিপুল ঐশ্বর্যের সাথে যুক্ত হয়েছিল সীমাহীন অহঙ্কার। নিজের সমৃদ্ধি জাহির করার উদ্দেশ্যে, কুবের একবার মহাদেব শিব এবং দেবী পার্বতীকে এক জমকালো ভোজের আমন্ত্রণ জানালেন। কুবেরের মনোভাব বুঝতে পেরে শিব ও পার্বতী বিনীতভাবে সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তবে একটি মৃদু হাসি হেসে তাঁরা তাঁদের কনিষ্ঠ পুত্র, বাল গণেশকে সেই ভোজে পাঠালেন।
Ganeshji : মহোদরের সূক্ষ্ম বার্তা: গণেশের ভুঁড়ি আমাদের কী শেখায়?
ক্ষুধা যখন সীমাহীন
কুবের ভাবলেন, এই মোটাসোটা, কৌতুকপ্রিয় ছোট ছেলেটিকে সন্তুষ্ট করা তো খুবই সহজ। রাজকীয় সোনার হলঘরে রাশি রাশি মিষ্টি, লাড্ডু ও বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার সাজানো হয়েছিল। কিন্তু কুবেরের হতবাক করে দিয়ে দেখা গেল, গণেশের ক্ষুধা যেন অন্তহীন। একের পর এক থালা মুহূর্তের মধ্যে শূন্য হতে লাগল, তবুও বাল গণেশ আরও খাবারের জন্য কেঁদে উঠলেন।
শীঘ্রই রাজবাড়ির হেঁশেলের প্রতিটি পদ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু গণেশের ক্ষুধা কেবল বেড়েই চলল। তিনি তখন প্রাসাদের আসবাবপত্র, সজ্জা এমনকি কুবেরকেও গিলে ফেলার হুমকি দিলেন, যদি না আরও খাবার দেওয়া হয়। কুবের তখন ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বিশ্বের ধন-সম্পদ তাঁর কাছে থাকা সত্ত্বেও, এই সামান্য শিশুর ক্ষুধার কাছে তিনি সম্পূর্ণ অসহায়। তাঁর সকল ঐশ্বর্য অসার।
শিব-পার্বতীর শরণাপন্ন কুবের ও ভক্তিতে মুক্তি
দিশেহারা হয়ে কুবের কৈলাস পর্বতে ছুটে গেলেন এবং শিব-পার্বতীর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। তিনি নিজের অহঙ্কারের কথা স্বীকার করে বললেন যে, ঐশ্বরিক ইচ্ছার কাছে তাঁর সমস্ত সম্পদ শক্তিহীন।
স্নেহময়ী পার্বতী তখন মৃদু হেসে কুবেরের হাতে দিলেন এক পাত্র সাধারণ চাল ভাজা । কুবের দ্রুত ফিরে এলেন, বিনম্রভাবে হাতজোড় করে সেই সামান্য খাদ্য গণেশকে নিবেদন করলেন। কুবেরের অকপট বিনয় দেখে গণেশের ক্ষুধা তৎক্ষণাৎ নিবারণ হলো।
Ganeshji : যে কারণে প্রতিটি শুভ কাজে প্রথমে গণেশের পূজা করা হয়….
এই কাহিনির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
এই মনোমুগ্ধকর গল্পটি বেশ কয়েকটি গভীর আধ্যাত্মিক সত্য বহন করে:
- ঐশ্বর্যের মিথ্যা অহঙ্কার: কুবেরের সম্পদের গর্ব এক মুহূর্তে চূর্ণ হলো। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বিনয় ছাড়া সম্পদ কেবলই শূন্য।
- মানুষের অতৃপ্ত বাসনা: গণেশের অন্তহীন ক্ষুধা মানুষের সেই বাসনাগুলির প্রতীক, যা কোনোদিন বস্তুগত প্রাপ্তি দিয়ে মেটানো যায় না। আমাদের ভেতরের অতৃপ্ত চাহিদাকে কেবল আত্ম-তৃপ্তি এবং আধ্যাত্মিকতা দিয়েই শান্ত করা সম্ভব।
- সরলতার শক্তি: সোনা ও জাঁকজমক যেখানে ব্যর্থ হলো, সেখানে সাধারণ এক মুঠো চাল সফল হলো। এটি দেখায় যে, ঈশ্বরের কাছে আড়ম্বর নয়, হৃদয়ের আন্তরিকতা ও শুদ্ধতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
- গণেশ হলেন অহঙ্কার বিনাশকারী: বিঘ্নহর্তা (বাধা দূরকারী) হওয়ার পাশাপাশি গণেশ অহঙ্কার বা অহংকেও দূর করেন। তিনি আমাদের আত্মসমর্পণের পথ শেখান।
কুবের ও গণেশের এই উপাখ্যানটি কেবল একটি পৌরাণিক গল্প নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক দর্পণ। এটি আমাদের শেখায়, জীবনের ভোজের টেবিলে সম্পদ বা প্রদর্শনী দিয়ে ঐশ্বরিক ক্ষুধাকে মেটানো যায় না; কেবল বিনয় ও ভক্তি দিয়েই তা সম্ভব। আজকের বিলাসবহুল জীবন এবং জাঁকজমকের যুগে, এই গল্পটি আমাদের এই মূল্যবান শিক্ষা দেয় যে, শুদ্ধ হৃদয় নিয়ে করা একটি সাধারণ নিবেদনও ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।