kojagori lakshmi puja

ব্যুরো নিউজ ০৬ অক্টোবর ২০২৫ : আজ, সোমবার, ৬ই অক্টোবর ২০২৫, মহাপুণ্যের কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা। এই রাতটি শরৎকালের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় এবং একে শারদ পূর্ণিমা বা কোজাগরী ব্রত নামেও অভিহিত করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই উজ্জ্বল পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী মর্ত্যলোকে নেমে এসে প্রশ্ন করেন, “কো জাগর্তি?” বা “কে জেগে আছে?”—যাঁরা ভক্তি ও সচেতনতার সঙ্গে জেগে থাকেন, তাঁরাই পান দেবীর অক্ষয় আশীর্বাদ।

লক্ষ্মী পূজা শুরু হচ্ছে ৬ই অক্টোবর দুপুর ১২:২৩ মিনিটে এবং নিশীথকাল (পূজার শ্রেষ্ঠ সময়) হলো রাত ১১:৪৬ মিনিট থেকে ১২:৩৪ মিনিট পর্যন্ত। এই দিব্য রাতে জাগরণের মাধ্যমেই সাধক তাঁর জীবনে ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক আনন্দকে স্বাগত জানান।

 

লক্ষ্মী কেন চঞ্চলা: দেবীর বিচরণ পথের রহস্য

শাস্ত্র অনুসারে, দেবী লক্ষ্মী কেবল ধন-সম্পদের প্রতীক নন; তিনি চঞ্চলা—অস্থির, সদা-গতিময়ী। যেখানে বিশৃঙ্খলা, অপরিষ্কার বা লোভ বিরাজ করে, সেখানে তিনি স্থায়ী হন না। তিনি নীরব রাতে বিচরণ করেন সেই স্থানগুলির সন্ধানে, যা তাঁর কৃপা পাওয়ার যোগ্য। পদ্ম পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং স্কন্দ পুরাণে দেবীর এই রাত্রীকালীন বিচরণের সাতটি স্থান ও শর্তের উল্লেখ রয়েছে, যা কেবল স্থান নয়, সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতাশৃঙ্খলাকে নির্দেশ করে।

সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ

১. পবিত্র এবং সচেতন গৃহে

পদ্ম পুরাণ অনুসারে, যে ঘরগুলি পরিষ্কার, সুশৃঙ্খল এবং প্রদীপের আলোয় আলোকিত থাকে, লক্ষ্মী দেবী রাতে সেই ঘরগুলিতে প্রবেশ করেন। অন্ধকার, অপরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বা অবহেলা অলক্ষ্মীকে (দুর্ভাগ্যের দেবী) আহ্বান করে। তাই, সন্ধেবেলায় প্রদীপ জ্বালানো এবং ঘরকে পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি—কারণ সমৃদ্ধি সেখানেই প্রবাহিত হয়, যেখানে পবিত্রতা ও সচেতনতা থাকে।

 

২. পবিত্রতা ও আলপনায় সজ্জিত দরজায়

স্কন্দ পুরাণ গৃহের প্রবেশদ্বারের পবিত্রতার ওপর জোর দেয়। প্রবেশদ্বারকে বাইরের জগৎ ও ভেতরের পবিত্রস্থানের মিলনস্থল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাতে দেবী লক্ষ্মী দরজার চৌকাঠে ক্ষণিকের জন্য থামেন, তিনি প্রবেশ করবেন কি না, তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এই কারণেই আলপনা, রঙ্গোলি বা প্রদীপ দিয়ে ঘর সাজানো হয়—যা দেবী লক্ষ্মীকে ঘরে প্রবেশের জন্য প্রতীকী আমন্ত্রণ জানায়।

 

৩. পবিত্র নদী তীরে

গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী ও কাবেরী-সহ অন্যান্য নদীর তীরগুলি লক্ষ্মীর সূক্ষ্ম উপস্থিতির সঙ্গে যুক্ত। লোকবিশ্বাস অনুসারে, তিনি মধ্যরাতে একটি পদ্মের ওপর নেমে এসে জলকে আশীর্বাদ করেন। এর আধ্যাত্মিক অর্থ হলো—সমৃদ্ধি প্রকৃতির দান এবং তা জলের বিশুদ্ধতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

 

৪. শস্যভাণ্ডার ও খাদ্য সঞ্চয়স্থানে

কৃষিভিত্তিক ঐতিহ্যে লক্ষ্মী ধন-লক্ষ্মী (সম্পদ) এবং ধান্য-লক্ষ্মী (শস্য ও খাদ্য) রূপে পূজিত হন। বিষ্ণু পুরাণ তাঁর কৃষি প্রাচুর্যের সঙ্গে সংযোগকে তুলে ধরে। রাতে তিনি শস্যভাণ্ডার ও খাদ্য সঞ্চয়স্থলে প্রবেশ করেন। খাদ্য অপচয় করা বা অবহেলা করা হলে তিনি সেই স্থান থেকে ফিরে যান। এই বিশ্বাস আমাদের সম্পদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়।

 

৫. যেখানে মন্দিরের প্রদীপ অক্ষত থাকে

বিষ্ণু ও লক্ষ্মী মন্দিরগুলিতে সারারাত অখণ্ড জ্যোতি বা অবিরাম প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শেষ ভক্ত মন্দির ছেড়ে চলে যাওয়ার পর লক্ষ্মী দেবী নিজেই সেই পবিত্র স্থানে আসেন, যা শাশ্বত শিখার প্রতি তাঁর আকর্ষণকে প্রকাশ করে। এই ঐতিহ্য দেখায় যে, সমৃদ্ধি সেই নিষ্ঠার প্রতি সাড়া দেয় যা রাতের নিস্তব্ধতায়ও নিভে যায় না।

 

৬. যেখানে সমাজে ঐক্য ও ধর্ম বজায় থাকে

বিষ্ণু পুরাণ উল্লেখ করে, যে সমাজে ধর্ম বজায় থাকে, সত্য কথা বলা হয় এবং ঐক্য বিরাজ করে, লক্ষ্মী দেবী সেই সম্প্রদায়কে পছন্দ করেন। রাতে তিনি এমন গ্রাম ও শহরে বিচরণ করেন এবং সম্মিলিত কল্যাণের আশীর্বাদ করেন। যেখানে কলহ, অসততা বা অবিচার থাকে, তিনি সেই স্থান ত্যাগ করেন।

 

৭. প্রকৃতির নীরব আশ্রমে

ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং মধ্য ভারতের স্থানীয় লোককথা অনুসারে, গভীর বনের ছোট মন্দিরগুলিতেও লক্ষ্মী পূজা করা হয়। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেন, তিনি নীরবে সেখানে আবির্ভূত হন এবং মাটি, ফসল ও বনকে আশীর্বাদ করেন। এই বিশ্বাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সম্পদ কেবল প্রাসাদ বা মন্দিরে সীমাবদ্ধ নয়, তা পৃথিবীর উর্বরতা এবং প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের সঙ্গেও জড়িত।

Lord Shiva : কেন দেবতারাও জানতেন না সিদ্ধ কুণ্জিকা স্তোত্রের শক্তি? শিবের তিন মহা-রহস্য !

জাগরণ ও সচেতনতার গভীর অর্থ

লক্ষ্মীদেবীর রাত্রীকালীন বিচরণ আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সমৃদ্ধি কখনই স্থায়ী নয়, এটি সর্বদা শৃঙ্খলা, পবিত্রতা এবং ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল।

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা কেবল ধন-সম্পদ চাওয়ার উৎসব নয়। এটি অভ্যন্তরীণ চেতনার জাগরণের উৎসব। সারারাত উপবাস ও জাগরণ (জেগে থাকা) দ্বারা আমরা দেবী লক্ষ্মীকে প্রমাণ করি যে আমরা তাঁর কৃপা লাভের জন্য প্রস্তুত ও সচেতন। সম্পদ, শান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের জন্য ভক্তি, শৃঙ্খলা এবং আনন্দের এই অপূর্ব মিশ্রণই কোজাগরী পূজার মূল বার্তা।

তিনি সেই স্থানেই প্রবেশ করেন, যেখানে আলো, শৃঙ্খলা, কৃতজ্ঞতা এবং ন্যায়বিচার থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর