sarvshaktiman bajrangbali

ব্যুরো নিউজ ০৭ অক্টোবর ২০২৫ : “আঞ্জনেয় মতিপাটলাননং, কাঞ্চনাদ্রি কমনীয় বিগ্রহম্। পারিজাততরুমূলবাসিনং, ভাবয়ামি পবমান নন্দনম্॥”
অর্থাৎ: “আমি পবনের আনন্দস্বরূপ আঞ্জনেয়কে ধ্যান করি, যার মুখমণ্ডল রক্তপদ্মের মতো উজ্জ্বল, শরীর স্বর্ণপর্বতের মতো দীপ্তিময়, এবং যিনি পারিজাত বৃক্ষমূলে বাস করেন।”

হিন্দু পুরাণের সমস্ত বীর চরিত্রের মধ্যে হনুমানজি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক আসনে অধিষ্ঠিত। তিনি কেবল তাঁর অসীম শারীরিক শক্তির জন্যই পূজিত নন, তাঁর দিব্য উৎপত্তি, অমরত্ব এবং শ্রীরামের প্রতি অবিচল ভক্তিও তাঁকে মহিমান্বিত করেছে। ভীম বা অর্জুনের মতো যোদ্ধারা নিজ নিজ সময়ে শক্তিশালী ছিলেন, কিন্তু হনুমানের শক্তিকে মনে করা হয় সীমাহীন, শাশ্বত এবং ধর্মের সাথে অবিচ্ছেদ্য।

আসুন, সেই সাতটি মূল কারণ অনুসন্ধান করি, যা হনুমানজিকে হিন্দু পুরাণের শ্রেষ্ঠতম শক্তিমান সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে:

 

১. দৈব জন্ম ও শিবের শক্তি সঞ্চার

হনুমান কোনো সাধারণ বানর রূপে জন্মগ্রহণ করেননি। পুরাণ অনুসারে, তিনি স্বয়ং মহাদেবের একাদশ রুদ্র অবতার হিসেবে পৃথিবীতে এসেছিলেন বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামকে সহায়তা করার জন্য। তাঁর জন্মলীলায় বায়ুদেব তাঁকে ‘প্রাণ’ (জীবন শক্তি) প্রদান করেন এবং শিবের সারমর্ম তাঁকে অতুলনীয় শক্তি দান করে। বায়ুদেবের জীবনীশক্তি এবং শিবের ধ্বংসাত্মক ও সৃজনশীল শক্তির এই দ্বৈত উৎস হনুমানজিকে অন্য সকলের থেকে আলাদা করেছে। তিনি গতি, শক্তি এবং দৈব চেতনার ভারসাম্য বহন করেন।

Hanumanji : সনাতন ধর্মের সর্ব বৃহৎ শক্তিধর এবং বীর ভক্ত হনুমান শৈশবে কেন হারিয়েছিল তাঁর দৈব গুণ ? রাম নামের মহত্য

২. দেব-দেবীর সম্মিলিত বরদান

ছোটবেলায় খেলাচ্ছলে হনুমানজির কাণ্ডকারখানা প্রায়শই ঋষিদের শান্তি বিঘ্নিত করত। তাঁর অমিত তেজ দেখে দেবতারা তাঁকে অসাধারণ বরদানে ভূষিত করেন। অগ্নিদেব তাঁকে অগ্নিতে অনাক্রম্যতা দেন, বরুণদেব জল থেকে রক্ষা করেন, সূর্যদেব তাঁকে জ্ঞান ও শিক্ষার বর দেন, বায়ুদেব তাঁর সহনশীলতা বৃদ্ধি করেন এবং বিশ্বকর্মা তাঁকে সমস্ত স্বর্গীয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করে তোলেন। এই সম্মিলিত আশীর্বাদ হনুমানজিকে প্রাকৃতিক উপাদান এবং অতিপ্রাকৃত আক্রমণ উভয়ের কাছেই অপরাজেয় করে তোলে, যা তাঁকে দেব এবং অসুর উভয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে।

 

৩. অষ্টসিদ্ধির (Eight Perfections) অধিপতি

হনুমানজি একজন সিদ্ধ যোগী হিসেবে পূজিত, যিনি অষ্ট সিদ্ধি—অর্থাৎ আটটি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা—আয়ত্ত করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে:

  • অসীম বড় হওয়ার ক্ষমতা (মহিমা)
  • অসীম ছোট হওয়ার ক্ষমতা (অণিমা)
  • অত্যন্ত হালকা হওয়ার ক্ষমতা (লঘিমা)
  • অত্যন্ত ভারী হওয়ার ক্ষমতা (গরিমা)

এই শক্তিগুলির মাধ্যমে তিনি এক লম্ফে সমুদ্র পার হতে পারতেন, পর্বত উপড়ে আনতে পারতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী যেখানে খুশি আবির্ভূত হতে পারতেন। অন্যান্য যোদ্ধারা অস্ত্রের ওপর নির্ভর করলেও, হনুমানজির শক্তি তাঁর অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত, যা যোগিক দক্ষতা এবং দৈব অনুগ্রহ দ্বারা চালিত।

 

৪. চিরঞ্জীবি: তাঁর অমরত্ব

হিন্দু পুরাণে হাতে গোনা যে ক’জন সত্তা চিরঞ্জীবি (অমর) উপাধি পেয়েছেন, হনুমানজি তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, পৃথিবীতে যতক্ষণ শ্রীরামের নাম উচ্চারিত হবে, ততক্ষণ তিনি জীবিত থাকবেন। এর অর্থ হলো, তাঁর শক্তি কোনো নির্দিষ্ট যুগ বা অবতারের সঙ্গে বাঁধা নয়, বরং তা যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান। তাঁর এই অমরত্ব, অপরাজেয়তার সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে এক চিরন্তন রক্ষক-এর মর্যাদা দিয়েছে, যিনি ধর্ম রক্ষার জন্য সর্বদা উপস্থিত থাকবেন।

 

৫. নবগ্রহের ওপর তাঁর আধিপত্য

হনুমানজিকে নবগ্রহের (নয়টি গ্রহের শক্তি) উপর প্রভাব বিস্তারকারী বলে মনে করা হয়, যা দেবতাদের মধ্যেও বিরল। বিশেষত, শনি (শনির প্রভাব) তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে হনুমানজি তাঁর ভক্তদের গ্রহের অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা করবেন। কারণ হনুমানজি রাবণের কারাগার থেকে শনিদেবকে উদ্ধার করেছিলেন। হনুমানের শক্তির এই মহাজাগতিক মাত্রা শারীরিক শক্তির ঊর্ধ্বে। এটি প্রকাশ করে যে তাঁর শক্তি ভাগ্যকেও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে, যা অন্য কোনো যোদ্ধার ক্ষেত্রে এত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান নয়।

Hanumanji : হনুমান কেন সঙ্কট মোচনের প্রতীক ? জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা …….

৬. শক্তির সংযম ও নৈতিক ব্যবহার

হনুমানজির শক্তির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো শৈশবে পাওয়া তাঁর অভিশাপ: তিনি নিজের অসীম ক্ষমতা ভুলে যাবেন, যতক্ষণ না কেউ তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেবে। এটি নিশ্চিত করেছিল যে তিনি অহংকার বা আবেগের বশে তাঁর শক্তির অপব্যবহার করবেন না। যখনই তাঁর ক্ষমতার প্রয়োজন হয়েছে—যেমন লঙ্কা লম্ফন বা সঞ্জীবনী পর্বত বহন—তা ছিল সেবার কাজ, অহংকারের নয়। এই সংযম তাঁর শক্তিকে একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মাত্রায় উন্নীত করেছে, যা প্রমাণ করে যে তাঁর ক্ষমতা আধিপত্য নয়, বরং বিনয় ও ধর্ম দ্বারা চালিত।

 

৭. ভক্তিই তাঁর পরম শক্তির উৎস

অন্যান্য পৌরাণিক চরিত্রের মতো বিজয় বা অহংকারের জন্য শক্তি ব্যবহার না করে, হনুমানজির সমস্ত কাজের মূলে ছিল শ্রীরামের প্রতি তাঁর অবিচল ভক্তি। তাঁর শারীরিক ক্ষমতা, অমরত্ব এবং সিদ্ধিগুলিও তাঁর ভক্তির কাছে গৌণ ছিল। অসীম শক্তির সাথে অসীম বিনয়ের এই সংমিশ্রণই তাঁকে অজেয় করে তুলেছে। ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, তিনি সর্বত্র কেবল শ্রীরামকেই দেখতেন এবং সেই দর্শন থেকেই তিনি এমন শক্তি লাভ করতেন যা দেবতাদেরও ছাড়িয়ে যেত। অতএব, তাঁর শক্তি কেবল শারীরিক বা মহাজাগতিক নয়—তা হলো আধ্যাত্মিক শক্তি, যা ঐশ্বরিক সত্তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জন্ম নেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর