Shiva Gajanan

ব্যুরো নিউজ ২৫শে আগস্ট ২০২৫ : পৌরাণিক কাহিনীগুলি কেবল প্রাচীন গল্প নয়, এগুলি আমাদের জীবনের গভীর সত্যের প্রতিফলন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের এই কাহিনীটি আমাদের শেখায় যে, জীবনের প্রতিটি ঘটনা, আপাতদৃষ্টিতে যা তুচ্ছ বা আকস্মিক বলে মনে হয়, তা আসলে একটি বৃহত্তর নিয়তির অংশ। শ্রী গণেশের গজ-মস্তক প্রাপ্তির অলৌকিক ঘটনাটি দুটি পৃথক কাহিনীর সুতোয় গাঁথা—একটি দুর্বাসা মুনির অভিশাপ এবং অন্যটি শনিদেবের দৃষ্টির প্রভাব।

 

দুর্বাসা মুনির আশীর্বাদ ও ইন্দ্রের অহংকার

একদা মহর্ষি দুর্বাসা বৈকুণ্ঠ থেকে কৈলাসে যাত্রা করছিলেন। পথে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে অপ্সরা রম্ভার সঙ্গে দেখতে পেলেন। ইন্দ্র মুনির প্রতি শ্রদ্ধা জানালে দুর্বাসা খুশি হয়ে তাঁকে একটি পারিজাত ফুল উপহার দেন, যা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত। এই ফুলের মাহাত্ম্য ছিল অপরিসীম। ঋষি বলেছিলেন, এই ফুল যে ধারণ করবে, সে সকল বাধা থেকে মুক্ত হবে এবং সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী হবে। তার প্রতি দেবী লক্ষ্মীর কৃপা থাকবে এবং সে জ্ঞান, তেজ ও বীরত্বে বিষ্ণুর সমান হবে। কিন্তু ইন্দ্র রম্ভার নেশায় মগ্ন থাকায় ফুলের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তিনি ফুলটি তার ঐরাবত গজরাজের মাথায় স্থাপন করেন। ফলস্বরূপ, ফুলটির অলৌকিক ক্ষমতা ঐরাবতের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ঐরাবত অন্যান্য হাতিদের পরাজিত করে এবং ইন্দ্রকে ছেড়ে চলে যায়। নিয়তির এমনই পরিহাস যে, যে আশীর্বাদ ইন্দ্রের পাওয়ার কথা ছিল, তা একটি হাতির ভাগ্যে জোটে। তবে এই ঘটনাটি ছিল শ্রী গণেশের গজ-মস্তক প্রাপ্তির একটি পূর্বশর্ত, যা তখনো পর্যন্ত অজানা ছিল।

Lord Shiva : মহাদেবের অপ্রচলিত দশটি নামের তাৎপর্য

শনিদেবের দৃষ্টি ও পার্বতীর পুত্রস্নেহ

গণেশজির জন্মের পর সকল দেব-দেবী তাঁকে দেখতে কৈলাসে আসেন। শনিদেবও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তিনি শিশু গণেশের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছিলেন না, বরং চোখ নামিয়ে রেখেছিলেন। দেবী পার্বতী এর কারণ জানতে চাইলে শনিদেব ব্যাখ্যা করেন যে, তাঁর দৃষ্টিতে অভিশাপ আছে। ছোটবেলায় শ্রী কৃষ্ণের তপস্যায় মগ্ন থাকায় তাঁর স্ত্রী রাগান্বিত হয়ে তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তিনি যার দিকেই তাকাবেন, তার ধ্বংস অনিবার্য। তাই তিনি সকল প্রাণীকে এই অভিশাপ থেকে রক্ষা করার জন্য সর্বদা দৃষ্টি নিম্নগামী করে রাখেন। শনিদেবের এই কথা শুনে পার্বতী ও উপস্থিত দেবীরা হেসে উঠলেন। পার্বতী বলেন যে, সমগ্র বিশ্ব ভগবানের ইচ্ছানুসারে চলে, শুধু নিয়তির দ্বারা নয়। তিনি শনিদেবকে তার পুত্রের দিকে দেখতে অনুরোধ করেন। পার্বতীর অনুরোধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শনিদেব ডান চোখের কোণ দিয়ে একবার গণেশের দিকে তাকান এবং তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে স্থান ত্যাগ করেন।

Ganesh Chaturthi : বিঘ্নহর্তা গণেশের শ্রেষ্ঠ ৫ মন্দির, গণেশ চতুর্থী উদযাপনে ভক্তদের আকর্ষণ

নিয়তির মিলন: গজ-মস্তক লাভ

এই ঘটনার কিছুকাল পরে, পার্বতী যখন স্নান করছিলেন, তখন গণেশকে দ্বাররক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। শিব যখন ভিতরে প্রবেশ করতে যান, তখন গণেশ তাঁকে বাধা দেন। পুত্রকে চিনতে না পেরে এবং নিজের অপমান বোধ করে মহাদেব শ্রী গণেশের মস্তক ছিন্ন করে দেন। শ্রী গণেশের মস্তক গোলকে প্রবেশ করে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিশে যায়।
পুত্রশোকে বিলাপ করতে থাকা পার্বতীকে দেখে দেব-দেবীরা ভীত হয়ে পড়েন। তখন ভগবান বিষ্ণু গরুড়ে চড়ে উত্তর দিকে যাত্রা করেন এবং সেই ঐরাবতকে খুঁজে পান, যার মাথায় একদা দুর্বাসা মুনির পারিজাত ফুলটি ছিল। বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে ঐরাবতের মস্তক ছিন্ন করেন এবং তা শ্রী গণেশের দেহের সঙ্গে যুক্ত করে তাঁকে পুনর্জীবিত করেন।

এভাবেই দুটি পৃথক ঘটনা একসূত্রে বাঁধা পড়ে। যে পারিজাত ফুলের শক্তি একসময় ঐরাবতের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, সেই শক্তিই গজ-মস্তক রূপে শ্রীগণেশের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। শ্রীগণেশ কেবল একটি হাতির মাথা পাননি, তিনি সেই গজ-মস্তকের মাধ্যমে পারিজাত ফুলের সমস্ত আশীর্বাদ লাভ করেন। এই কারণেই তিনি বিঘ্নহর্তা বা সকল বাধা দূরকারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই গাথা আমাদের শেখায় যে, প্রতিটি ঘটনা, এমনকি আপাতদৃষ্টিতে যা দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে হয়, তার পেছনেও এক গভীর উদ্দেশ্য থাকে। নিয়তির অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে এক অলৌকিক পরিণাম রচিত হয়। গণেশজির কাহিনী আমাদের এই বিশ্বাস দেয় যে, জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের পেছনে ঈশ্বরের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে, যা আমাদের মঙ্গলের জন্যই কাজ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর