ব্যুরো নিউজ ২৫শে আগস্ট ২০২৫ : সনাতন ধর্মের বিশাল দেবমণ্ডলীর মধ্যে মহাদেব শিব এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি কেবল একজন দেবতা নন, বরং এক শাশ্বত নীতি, জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে এক মহাজাগতিক বাস্তবতা। মহাদেব, ভোলেনাথ, এবং নটরাজ-এর মতো পরিচিত নামগুলি ছাড়াও, শাস্ত্র এবং প্রাচীন স্তোত্রগুলিতে শিবের আরও অনেক নামের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলির গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। এই “অপ্রচলিত” বা কম পরিচিত নামগুলি কেবল কাব্যিক উপাধি নয়, বরং ঐশ্বরিক গুণাবলীর এক একটি স্পন্দন, যা শিবের অসীম প্রকৃতির এক একটি স্বতন্ত্র দিক তুলে ধরে।
১. হর (Hara): মায়ার বিনাশকারী
‘হর’ নামটি এসেছে সংস্কৃত মূল ‘হৃ’ থেকে, যার অর্থ “দূরে সরিয়ে নেওয়া” বা “অপসারণ করা”। হর রূপে শিব হলেন পাপ, অহংকার, দুঃখ এবং অজ্ঞতার বিনাশকারী। এটি কেবল বাহ্যিক সাহায্য নয়, বরং অভ্যন্তরীণ রূপান্তর। “হর হর মহাদেব” মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে ভক্তরা শিবের এই শক্তিকেই আহ্বান করে থাকেন – যা আত্মাকে আচ্ছন্ন করে থাকা মোহ এবং মায়াকে অপসারণ করে। হর কেবল বাইরের জগতকে ধ্বংস করেন না, তিনি অবিদ্যা (অজ্ঞান) দূর করে মোক্ষ লাভের পথ খুলে দেন। মনের ঘোর অন্ধকার মুহূর্তে “হর”-কে আহ্বান করা মানেই আপনার এবং আপনার প্রকৃত সত্তার মাঝে থাকা বাধাগুলোকে দূর করার জন্য প্রার্থনা করা।
২. ভব (Bhava): সমস্ত সত্তার উৎস
যজুর্বেদের ‘শ্রী রুদ্রম’-এ উল্লিখিত ভব শব্দের অর্থ “যাঁর থেকে সমস্ত অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়”। শিব কেবল ধ্বংসকারী নন, তিনি সেই নীরব বীজও, যা থেকে সবকিছু জন্ম নেয়। সৃষ্টির আগে, রূপ ধারণ করার আগে, এমনকি মহাজাগতিক গর্ভে আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠারও আগে – ভব ছিলেন। শিবকে ভব হিসেবে জানার মাধ্যমে আমরা স্বীকার করি যে জীবন নিজেই ঐশ্বরিক, এবং প্রতিটি সত্তা – একটি ঘাসের ফলক থেকে শুরু করে গোটা ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত – শিব তত্ত্ব দ্বারা পূর্ণ।
সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ
৩. শর্ব (Sharva): ভয়ঙ্কর বিনাশকারী
শর্ব হলেন শিবের সেই ভয়ঙ্কর রূপ, যিনি বজ্রের মতো গর্জন করে সমস্ত কিছু দ্রবীভূত, ভেঙে এবং ধ্বংস করে দেন। তবে এই ধ্বংস নেতিবাচক নয়। শর্ব পুরোনো কর্ম, অকেজো ব্যবস্থা, এবং ক্ষয়িষ্ণু জগৎকে নিশ্চিহ্ন করেন, যাতে একটি নতুন সূচনা হতে পারে। সৃষ্টি (সৃজন), স্থিতি (পালন) এবং লয় (বিনাশ)-এর চক্রে শর্ব লয়-কে মূর্ত করেন, যা পুনর্জন্মের আগে একটি প্রয়োজনীয় সমাপ্তি। মহাভারতে, যোদ্ধারা যুদ্ধের আগে শর্ব-কে আহ্বান করতেন, যাতে পরিশুদ্ধির জন্য ঐশ্বরিক অগ্নিকে আহ্বান করা যায়।
৪. উমাপতি (Umapati): উমার সঙ্গী
দেবী পার্বতীর আরেক নাম উমা, যিনি সৃষ্টির নারী শক্তি অর্থাৎ শক্তি-কে প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই উমাপতি হলেন উমার ঈশ্বর এবং প্রিয়তম, যা ঐশ্বরিক নারীশক্তির সাথে শিবের অবিচ্ছিন্ন মিলনকে সূচিত করে। এই নামটি এই ভ্রম দূর করে যে শিব কেবল একজন উদাসীন সন্ন্যাসী। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শক্তি ছাড়া শিব শবে পরিণত হন। উমাপতি বিপরীতের সমন্বয়কে প্রতিনিধিত্ব করে – স্থিরতা এবং গতিশীলতা, শূন্যতা এবং সৃজনশীল স্পন্দন – যা একসাথে মহাবিশ্বের বুনন তৈরি করে।
৫. মৃত্যুঞ্জয় (Mrityunjaya): মৃত্যুর জয়ী
মৃত্যুঞ্জয় নামটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের সাথে: “ওঁ ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টিবর্ধনম্। উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাত্।” মৃত্যুঞ্জয়-কে আহ্বান করা মানে কেবল শারীরিক মৃত্যু নয়, বরং মানসিক এবং আত্মিক মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্তি চাওয়া। মৃত্যুঞ্জয় রূপে শিব শিক্ষা দেন যে মৃত্যু কোনো শেষ নয়, বরং একটি প্রবেশপথ। যোগ এবং তন্ত্র সাধনায়, এই নামের উপর ধ্যান করা হলে ওজস (প্রাণশক্তি) শক্তিশালী হয়, অমরত্বের অনুভূতি জাগে এবং আত্মাকে অকাল বা অচেতন প্রস্থানের হাত থেকে রক্ষা করে।
৬. চন্দ্রপাল (Chandrapal): চাঁদের অধিপতি
শিবকে প্রায়শই তাঁর জটাশূলের উপর একটি অর্ধচন্দ্র (চন্দ্র) ধারণ করে থাকতে দেখা যায়। এই রূপের কারণেই তাঁর নাম চন্দ্রপাল – অর্থাৎ চাঁদের রক্ষক বা অধিপতি। বৈদিক প্রতীকবাদে, চাঁদ মন, আবেগ এবং সময়ের চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। চন্দ্রপাল রূপে শিব মনের শাসক, যিনি মনের অস্থিরতাকে অতিক্রম করার পথ দেখান। তিনি সোম-এর শীতল, প্রশান্তিদায়ক শক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করেন, যা উচ্চতর চেতনাকে পুষ্ট করে। চাঁদের বৃদ্ধি এবং ক্ষয় সময়ের অস্থায়িত্বকেও প্রতিনিধিত্ব করে, যা শিব পরম নিরপেক্ষতার সাথে পর্যবেক্ষণ করেন।
৭. বিশ্বেশ্বর (Vishveshwara): মহাবিশ্বের প্রভু
ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি করেন এবং বিষ্ণু যখন পালন করেন, তখন শিব – বিশ্বেশ্বর রূপে – সমগ্র মহাজাগতিক লীলার তত্ত্বাবধান করেন। তিনি কেবল কৈলাস পর্বতের উপরে বসে থাকা একজন দেবতা নন, বরং মহাবিশ্বকে পরিচালনা করে এমন অন্তর্নিহিত বুদ্ধিমত্তা। কাশী বিশ্বনাথের মতো মন্দিরগুলির নামকরণ এই রূপের নামে করা হয়েছে, কারণ এটি শিবের সর্বব্যাপী প্রভুত্বকে নির্দেশ করে। বিশ্বেশ্বর-কে জানার মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বকে যান্ত্রিক বা এলোমেলো না দেখে একে পবিত্র বলে বিবেচনা করি – যা সচেতনতা দ্বারা ধারণ করা এক ঐশ্বরিক নাটক।
৮. অজ (Aja): জন্মহীন, শাশ্বত সত্তা
অজ নামের আক্ষরিক অর্থ জন্মহীন, কিন্তু যিনি সর্বদা বিদ্যমান। প্রতিটি সত্তার একটি জন্ম তারিখ, একটি রূপ, একটি শুরু থাকে – কিন্তু অজ-এর কোনো শুরু ছিল না। তিনি কেবল আছেন। এটি শিবের নির্গুণ (নিরাকার) রূপ – যা সংসারের চক্র দ্বারা অস্পৃষ্ট। ধ্যানের সময় অজ-কে স্মরণ করা মানে আপনার নিজের আত্মাও জন্মহীন, এটি মনে রাখা। এটি সৃষ্টি হয়নি; এটি ধ্বংস করা যায় না। এটি নিজেই শিব।
৯. স্থাণু (Sthanu): অবিচল সত্তা
জীবনের চির-পরিবর্তনশীল নদীর মধ্যে, স্থাণু হলেন চেতনার সেই অপরিবর্তনীয় স্তম্ভ। এমনকি সংস্কৃত শব্দ “স্থাণু”-এর আক্ষরিক অর্থ দৃঢ়, অবিচল, শাশ্বত। তিনি হলেন অ্যাক্সিস মুন্ডি, মহাবিশ্বের কেন্দ্রীয় রেফারেন্স পয়েন্ট। যখন বিশ্ব ঘটনার অস্থিরতায় নাচে, তখন স্থাণু রূপে শিব অবিচল থাকেন – আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে নীরব সাক্ষী। গভীর ধ্যানে যোগী স্থাণু-এর মতো হয়ে ওঠেন – স্থির, অবিচল এবং আত্মায় প্রতিষ্ঠিত। এই স্থিরতা জড়তা নয়, বরং গতির ঊর্ধ্বে থাকা সচেতনতা।
১০. মহেশ্বর (Maheshwara): সমস্ত প্রাণীর মহাপ্রভু
এই মহৎ নাম – মহেশ্বর – এর অর্থ “মহাপ্রভু”, যিনি কেবল mortals (মরণশীল) নন, দেবতা, উপাদান, সময়, কর্ম এবং ভাগ্যেরও শাসক। তিনি হলেন পরম ঈশ্বর, যিনি গ্যালাক্সি থেকে শুরু করে পরমাণু পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তবুও, মহেশ্বর কোনো অত্যাচারী দেবতা নন। তিনি করুণা (দয়া), বৈরাগ্য (বিচ্ছিন্নতা), এবং জ্ঞান (প্রজ্ঞা)-এর সাথে শাসন করেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র এবং সরস্বতীর মতো মহান সত্তারাও তাঁকে পূজা করেন, কারণ তিনি তাঁদের নিজস্ব ঐশ্বরিক কার্যাবলীর উৎস। যখন আপনি মহেশ্বর-এর সামনে নত হন, তখন আপনি কোনো মূর্তির সামনে নত হন না – বরং সচেতনতা, যা স্বয়ং সচেতন এবং পরম, তারই সামনে নত হন।
Brahma ; সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সীমিত উপাসনা: এক বিস্ময়কর রহস্য !
এই নামগুলি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সনাতন ধর্মে, একটি নাম কেবল একটি লেবেল নয়, এটি একটি মন্ত্র, একটি প্রবেশপথ, একটি বাস্তবতা। শিবের এই কম পরিচিত নামগুলি গভীর অভিজ্ঞতার চাবিকাঠি:
- “হর” আপনাকে আসক্তি দূর করতে সাহায্য করে।
- “ভব” আপনাকে আপনার উৎস মনে করিয়ে দেয়।
- “শর্ব” আপনার নিজের অপ্রয়োজনীয় অংশগুলিকে ধ্বংস করার অনুমতি দেয়।
- “উমাপতি” আপনার সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রীতি নিয়ে আসে।
- “মৃত্যুঞ্জয়” মৃত্যুর ওপর সাহস দান করে।
- “চন্দ্রপাল” আপনার আবেগ শান্ত করে।
- “বিশ্বেশ্বর” আপনাকে ধর্মের সাথে সংযুক্ত করে।
- “অজ” আপনাকে আপনার শাশ্বত সত্তাকে উপলব্ধি করায়।
- “স্থাণু” অভ্যন্তরীণ স্থিরতা আনে।
- “মহেশ্বর” সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার কাছে আত্মসমর্পণ শেখায়।
আপনি এই নামগুলি জোরে উচ্চারণ করুন বা নীরবতায় সেগুলির উপর ধ্যান করুন, এই নামগুলি আধ্যাত্মিক হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে – আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিব কেবল হিমালয়েই নন, বরং আমাদের নিঃশ্বাসে, আমাদের কোষে এবং আমাদের নীরবতার মধ্যে বিরাজমান।
একের অনেক দিক
ভগবান শিবের সৌন্দর্য তাঁর विरोধাভাসে নিহিত। তিনি ধ্বংসকারী এবং পালনকারী, নৃত্যশিল্পী এবং স্থিরতা, সন্ন্যাসী এবং গৃহী, রূপ এবং নিরাকার। তাঁর প্রতিটি কম পরিচিত নাম একটি ভিন্ন দিক প্রকাশ করে – অসীমের একটি জানালা। শিবকে জানা মানে তাঁকে একটি রূপ, একটি গল্প বা একটি কার্যে সীমাবদ্ধ করা নয়। শিবকে জানা মানে ছেড়ে দেওয়া, প্রক্রিয়াটিকে বিশ্বাস করা, লয়কে আলিঙ্গন করা এবং সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে তার মধ্যে মিশে যাওয়া। পরের বার যখন আপনি একটি শিবলিঙ্গে জল নিবেদন করবেন বা ঐশ্বরিকের উপর ধ্যান করবেন, তখন কেবল “ওঁ নমঃ শিবায়” নয় – বরং “ওঁ হরায় নমঃ,” “ওঁ ভবায় নমঃ,” “ওঁ মৃত্যুঞ্জয়ায় নমঃ” জপ করুন। আপনি হয়তো সেই শাশ্বত সত্তার এক গভীরতর অভিজ্ঞতার দ্বার উন্মোচন করতে চলেছেন।