শুদ্ধাত্মা মুখার্জি , ১৪ ই আগস্ট ২০২৫ : ভারত এক সময় পশ্চিমী বিশ্বের কাছে ‘সোনে কি চিড়িয়া’ বা স্বর্ণ পক্ষী নামে পরিচিত ছিল। ভারতবর্ষ নিজেকে ঋষিভূমি হিসেবে চিনত, যেখানে কৃষ্ণসার হরিণ নির্ভয়ে বিচরণ করে। হাজার হাজার বছর ধরে গ্রীসের আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে মধ্যযুগের ইসলামিক আক্রমণকারী এবং আধুনিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পর্যন্ত, বহু আক্রমণকারী এই ভূমিকে জয় করার চেষ্টা করেছে, কারণ তাদের কাছে একে জয় করা মানে সমগ্র বিশ্ব জয় করা। উল্লেখ্য, ভারতে পৌঁছানোর তাগিদেই মধ্যযুগে নতুন বিশ্ব আমেরিকা পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছিল। সেই সময়ে বহু ইউরোপীয় বাণিজ্যিক সংস্থা তাদের নামে ভারতের নাম ব্যবহার করত, যেমন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অবশেষে, এই সমস্ত ঔপনিবেশিক শক্তি যখন ভারতে পৌঁছালো, দেশের বিপুল সম্পদ, খাদ্য সম্ভার, লোকবল এবং সৌন্দর্য দেখে তাদের নিছক বাণিজ্যিক স্বার্থ আর রইল না। তাদের মধ্যে অধিকার বিস্তারের লালসা জন্ম নিলো, এবং শুরু হলো ভারতবর্ষের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অধ্যায়।
স্বাধীনতার তারিখ: ১৫ই আগস্ট কেন?
অফুরন্ত সংগ্রাম ও ত্যাগের পর বিংশ শতকে ভারত যখন স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন পশ্চিমা বিশ্ব একটি প্রতীকী প্রভুত্বের চিহ্ন রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষে, আশা করা হয়েছিল যে ভারত ১৯৩০ সালে পূর্ণ স্বরাজ ঘোষণার দিন অর্থাৎ ২৬শে জানুয়ারি স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু তার পরিবর্তে, ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭-কে বেছে নেওয়া হয়, যা ছিল ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা যোদ্ধা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে ব্যঙ্গ করার একটি প্রচেষ্টা। ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট, পারমাণবিক বোমা হামলার পর জাপান ইংল্যান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। নেতাজি জাপানের সাহায্য নিয়েই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ছিলেন। তার অন্তর্ধান এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের পর, ১৯৪৬ সালে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি বিদ্রোহ ঘটলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সেই ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭-এই ভারতকে স্বশাসন বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দেয়। এটি পূর্ণ স্বরাজ ছিল না, কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে একটি মুক্তাঞ্চল। এই সত্যটি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের অজানা ছিল না, তাই দ্রুত সংবিধান গঠনের পর ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি ভারত একটি পূর্ণ স্বরাজ ও প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি লাভ করে।
স্বাধীন ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্ব রাজনীতির জটিলতা
আজকের ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্বের বিদ্রূপ থেকে মুক্ত নয়। স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর থেকেই ভারতীয়দের মধ্যে পশ্চিম বিশ্বের প্রতি একটি বিরূপ ধারণা তৈরি হয়, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিপুল সংখ্যক মানুষ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এই মনোভাবের কারণে ভারতের সরকারি নীতি সবসময় পশ্চিম বিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক মিত্র দেশ খুঁজেছে। ফলস্বরূপ, ভারতের বন্ধুত্ব তৎকালীন সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিকের সঙ্গে গভীর হয়, যা সেই প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক অস্তিত্ব পরিবর্তনের পরেও বর্তমান রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে বজায় রয়েছে। বর্তমানে, রাশিয়া ভারতের অন্যতম বাণিজ্য ও নিরাপত্তা অংশীদার। খনিজ তেল থেকে শুরু করে অস্ত্র প্রযুক্তি পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই তারা ভারতকে অংশীদার করেছে। কিন্তু অন্যদিকে, রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নৈতিকভাবে শত্রু দেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ইউক্রেন সংঘাত। রাশিয়া বহু দিন আগেই ইউক্রেনের সামরিক শক্তি ধ্বংস করে দিয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের অর্থ ও অস্ত্রের সহায়তায় ইউক্রেন টানা যুদ্ধ লড়ে চলেছে। এই যুদ্ধ শেষ করার জন্য বর্তমান উচ্চাভিলাষী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বছরের ১৫ই আগস্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একটি বৈঠক নির্ধারণ করেছেন। এই দিনটি ভারতের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার মতো একটি শান্তি চুক্তি আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও, সেদিন কি আবার ভারতের এক পরম মিত্রকে পশ্চিমা বিশ্ব নতি স্বীকার করতে বাধ্য করবে? নাকি আরও বৃহত্তর যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী অধ্যায় শুরু হবে?
India Independence Day : স্বাধীনতার ৭৯ বছরে ভারত: অতীতকে ছাড়িয়ে নতুন উচ্চতায় এক শক্তিশালী রাষ্ট্র
উল্লেখ্য, বাণিজ্য নীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে ভারত স্বাধীনচেতা হওয়ায় সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।