ব্যুরো নিউজ ১৪ অক্টোবর ২০২৫ : আফগানিস্তানের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ছয় দিনের ভারত সফরের অংশ হিসেবে শনিবার উত্তরপ্রদেশের ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দ ইসলামি সেমিনারিতে যান। এটিকে আঞ্চলিক গতিশীলতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মুত্তাকি তাঁর প্রতিনিধি দল নিয়ে সড়কপথে দিল্লি থেকে দেওবন্দ পৌঁছান। সেখানে দারুল উলুমের উপাচার্য মুফতি আবুল কাসিম নোমানি, জমিয়ত উলামা-এ-হিন্দ-এর সভাপতি মাওলানা আরশাদ মাদানি এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁকে পুষ্পবৃষ্টির মাধ্যমে স্বাগত জানান। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও শত শত শিক্ষার্থী ও বাসিন্দা তাঁকে অভিবাদন জানাতে মাদ্রাসার বাইরে ভিড় করে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মুত্তাকি এই অভ্যর্থনার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং আশা প্রকাশ করেন, “আমি এখানে দেখানো এমন দুর্দান্ত অভ্যর্থনা এবং ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞ। আমি আশা করি ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক আরও এগিয়ে যাবে।”
সফরের ধর্মীয় ও কূটনৈতিক তাৎপর্য
বিশ্লেষকরা মুত্তাকির এই সফরকে পাকিস্তানের প্রভাবমুক্ত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। এটি সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায় যেখানে পাকিস্তান দেওবন্দি ইসলামের প্রধান রক্ষক এবং তালেবানের প্রধান সমর্থক বলে দাবি করে। দেওবন্দ সফর করে মুত্তাকি বোঝাতে চেয়েছেন যে তালেবানের ধর্মীয় শিকড় ভারতেও রয়েছে, যা তাদের কূটনীতিতে পরিবর্তন এবং পাকিস্তানের ওপর নির্ভরতা কমানোর ইঙ্গিত দেয়।
১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামি প্রতিষ্ঠান। তালেবানরা এই সেমিনারিকে একটি মডেল প্রতিষ্ঠান হিসাবে মনে করে এবং এর স্নাতকদের আফগান সরকারি পদে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বর্তমানে আফগানিস্তানের প্রায় ১৫ জন শিক্ষার্থী দারুল উলুমে পড়াশোনা করছেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানের একজন উচ্চ নেতৃত্বর মন্ত্রীর ভারতের দেওবন্দ ইসলামি কেন্দ্রে সফর তালেবানের নীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়—অর্থাৎ পাকিস্তানের ওয়াহাবি হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে ভারতের দেওবন্দি সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে আসা। এই পরিবর্তন নিশ্চিতভাবে ভারত-আফগান সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে জোরদার করে।
জাভেদ আখতারের তীব্র সমালোচনা
তবে, এই উচ্চ পর্যায়ের সফর ঘিরে বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। সুপরিচিত পাকিস্তান-পন্থী প্রবীণ কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতার এই সংবর্ধনার তীব্র নিন্দা করেছেন। এক্স (X)-এ তিনি লেখেন, “বিশ্বের নিকৃষ্টতম সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর এক প্রতিনিধিকে যে ধরনের সম্মান দেওয়া হল, তা দেখে আমার মাথা লজ্জায় নত হয়ে যাচ্ছে।”
তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসার এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে এটিকে “ইসলামিক হিরো” আখ্যা দেওয়ার জন্য লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, এই দলটি মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আমার ভারতীয় ভাই ও বোনেরা, আমাদের কী হচ্ছে?”
জাভেদ আখতার বরাবরই ভারত পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতির লক্ষ্যে ‘আমন কি আশা’-এর পক্ষে থেকেছেন, যেখানে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্ত সন্ত্রাসে পূর্ণ সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। জাভেদ আখতার সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে প্রায়ই পাকিস্তান সফর করেন ।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট
তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এটিই ভারতের মাটিতে প্রথম উচ্চ-পর্যায়ের আফগান প্রতিনিধি দলের সফর। মুত্তাকি ১০ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করবেন।
দিল্লিতে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথে বৈঠকে মুত্তাকি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর জোর দেন এবং আফগানিস্তানের খনিজ খাতে ভারতের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ রয়েছে বলে জানান। তিনি দ্রুততম বাণিজ্য রুট হিসেবে ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য সহজ করার জন্য ভারতকে আহ্বান জানান।
এদিকে, এই সফর শুরু থেকেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আফগান দূতাবাসের একটি সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার অস্বীকার করার অভিযোগ ওঠে, যা নারীর অধিকার বিষয়ে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
মুত্তাকি ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা নতুন কূটনীতিক পাঠাব, এবং আমি আশা করি আপনারাও কাবুলে আসবেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের সফর ঘন ঘন হতে পারে।” তিনি ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়নে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার কথাও তুলে ধরেন, যদিও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।