ব্যুরো নিউজ ৬ জুন : শুক্রবার ভোরে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ সহ একাধিক অঞ্চলে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই হামলায় অন্তত তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিক খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে চারজন নিহত এবং ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ইউক্রেনের ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’ এর প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া এই ব্যাপক হামলা চালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ঘটনার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বিতর্কিত মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যেখানে তিনি ইউক্রেন ও রাশিয়াকে “কিছুক্ষণ যুদ্ধ করতে দেওয়ার” কথা বলেছেন।
কিয়েভে ভয়াবহ হামলা ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি:
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে শুক্রবার রাতভর ভয়াবহ ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রুশ সেনা। কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিটসকো নিশ্চিত করেছেন যে, হোলোসিইভস্কি এবং দারনিটস্কি জেলায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে, যা আবাসিক এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিয়েভ সিটি প্রশাসনের প্রধান টিমুর টাকাচেঙ্কো জানান, একাধিক বিস্ফোরণে শহরের বিভিন্ন অংশে আগুন লেগেছে এবং ধ্বংসাবশেষ পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বহু বাসিন্দা বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ইউক্রেনীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত সক্রিয় হয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাশিয়া বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করেছে। তারা তাদের অফিসিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেলে এই হামলা সম্পর্কে আপডেট প্রদান করেছে এবং নাগরিকদের সতর্ক থাকতে উৎসাহিত করেছে। কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলায় চারজন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে তিনজন উদ্ধারকর্মী। এছাড়াও, ৪০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। কিয়েভের সামরিক প্রশাসন জানিয়েছে, রাশিয়ার হামলায় শহরের মেট্রো স্টেশনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার কারণে মেট্রো চলাচলও ব্যাহত হয়েছে।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’-এর প্রতিশোধ:
রাশিয়ার এই নতুন হামলার ঢেউ ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’-এর সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী এই অভিযানের মাধ্যমে রাশিয়ার সামরিক অবকাঠামো পঙ্গু করার লক্ষ্য নিয়েছিল। ইউক্রেনীয় বাহিনী সফলভাবে ৪১টি রুশ বোমারু বিমান ধ্বংস করেছে বলে দাবি করেছে, যার মধ্যে A-50, TU-95, TU-22M3 এবং TU-160 বোমারু বিমানগুলি উল্লেখযোগ্য। এই কৌশলগত আঘাতগুলি রাশিয়ার আক্রমণাত্মক ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রতিশোধ নিতেই মস্কো এত বড় আকারের হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা SBU সূত্রে জানা গেছে, এই অভিযানের পরিকল্পনা অন্তত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে। ড্রোনগুলো রাশিয়ার ভেতরে চোরাপথে এনে ভাসমান কাঠের ঘরের আড়ালে একটি ট্রাকের ওপর রাখা হয়েছিল এবং মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল ইউক্রেনের হাতে।
রুশ-ইউক্রেন উত্তেজনা বৃদ্ধি:
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক অভিযানের মধ্যে এই হামলাগুলি এসেছে। ইউক্রেনের ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’ নিঃসন্দেহে মস্কোর কাছ থেকে একটি তীব্র পাল্টা আক্রমণকে ট্রিগার করেছে। যুদ্ধের এই নতুন পর্যায়ের ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে, এবং সহিংসতা কমানোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গতি পাচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে।
ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য:
যুদ্ধ যখন এমন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, ঠিক তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বৃহস্পতিবার জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্জের সাথে ওভাল অফিসের বৈঠকে ট্রাম্প বলেন যে, ইউক্রেন এবং রাশিয়াকে “কিছুক্ষণ যুদ্ধ করতে দেওয়াটাই ভালো হতে পারে” তাদের আলাদা করার এবং শান্তি স্থাপনের আগে।ট্রাম্প ইউক্রেনের যুদ্ধকে (যা ২০২২ সালের শুরুর দিকে রাশিয়ার আগ্রাসনে শুরু হয়েছিল) এমন দুটি ছোট শিশুর মধ্যে বিরোধের সাথে তুলনা করেছেন যারা একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। ট্রাম্প বলেন, “মাঝে মাঝে তাদের কিছুক্ষণ যুদ্ধ করতে দেওয়া এবং তারপর তাদের আলাদা করে দেওয়া ভালো।” তিনি আরও জানান যে, বুধবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তাদের ফোনালাপে তিনি এই উপমাটি উল্লেখ করেছেন।মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবশ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয় দেশের ওপরই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। ট্রাম্প বলেন, “যখন আমি দেখব যে এটি থামছে না… আমরা খুব, খুব কঠোর হব।”
জার্মান চ্যান্সেলরের অবস্থান:
ট্রাম্পের পাশে বসে যখন এই মন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন মের্জ জোর দিয়ে বলেন যে, যুদ্ধ এবং এর ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে তিনি এবং ট্রাম্প একই মত পোষণ করেন। তিনি ট্রাম্পকে “বিশ্বের মূল ব্যক্তি” বলে উল্লেখ করেন, যিনি রক্তপাত বন্ধ করতে সক্ষম। তবে মের্জ আরও জোর দিয়ে বলেন যে, জার্মানি “ইউক্রেনের পাশে আছে” এবং কিয়েভ কেবল সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে, রাশিয়ার বেসামরিক নাগরিকদের উপর নয়। ইউক্রেন সম্পর্কে মের্জ বলেন, “আমরা তাদের আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি।”
ভবিষ্যৎ পথ: পরিস্থিতি কীভাবে মোড় নেবে তা স্পষ্ট নয়, তবে সংঘাত থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উভয় পক্ষই সামরিক অভিযান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে, এবং বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। এই ধ্বংসাত্মক সংঘাতের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে আগামী দিনগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।