ব্যুরো নিউজ ২৭শে আগস্ট ২০২৫ : আজ, ২৭শে আগস্ট ২০২৫, বুধবার, সারা ভারত জুড়ে পালিত হচ্ছে এক পবিত্র এবং আনন্দময় উৎসব – গণেশ চতুর্থী। বিনায়ক চতুর্থী বা গণেশ উৎসব নামে পরিচিত এই ১০ দিনের মহোৎসবটি জ্ঞান, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের প্রতীক ভগবান গণেশের জন্মবার্ষিকী স্মরণে পালিত হয়। বিশেষত মহারাষ্ট্র, দিল্লি, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় এই উৎসব মহা ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়, আর কলকাতাতেও এখন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
গণেশ চতুর্থীর তিথি ও শুভলগ্ন:
দৃক পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, ভাদ্রপদ মাসের শুক্লপক্ষে ভগবান গণেশের জন্ম হয়েছিল, যা সাধারণত আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে পড়ে।
এই বছর, ২০২৫ সালের ২৬শে আগস্ট দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে চতুর্থী তিথি শুরু হয়ে ২৭শে আগস্ট দুপুর ৩টা ৪৪ মিনিটে শেষ হচ্ছে।
গণেশ পূজার মাদ্যাহ্ন মুহূর্তটি আজ, ২৭শে আগস্ট সকাল ১১:০৬ থেকে দুপুর ১:৪০ পর্যন্ত।
এই দশ দিন ধরে উৎসব চলার পর আগামী ৬ই সেপ্টেম্বর, শনিবার গণেশ বিসর্জন হবে।
Ganesh Chaturthi : বিঘ্নহর্তা গণেশকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি: পূজার উপকরণ থেকে সজ্জা, এক ঝলকে সব
গণেশের জন্মকথা: এক পৌরাণিক আখ্যান
হিন্দু পরম্পরা অনুসারে, গণেশ হলেন ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর পুত্র। পৌরাণিক কাহিনীতে বলা আছে, দেবী পার্বতী তাঁর দেহের নিঃসরণ থেকে গণেশকে সৃষ্টি করেন এবং তাঁকে নিজের কক্ষের প্রহরায় নিযুক্ত করেন। যখন ভগবান শিব ফিরে এসে দেখলেন গণেশ প্রবেশ পথ আটকাচ্ছেন, তখন তিনি ক্রোধে গণেশের মস্তক বিচ্ছিন্ন করেন। পুত্রশোকে কাতর পার্বতীর অনুরোধে শিব তখন একটি হাতির মস্তক দিয়ে গণেশকে নতুন জীবন দান করেন, আর সেই থেকেই তিনি গজানন নামে পরিচিত। এই ঘটনাটি শুধু এক পৌরাণিক আখ্যান নয়, বরং জন্ম, বিনাশ ও পুনর্জীবনের এক গভীর প্রতীকী অর্থ বহন করে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জাতীয়তাবাদের স্পন্দন
গণেশ চতুর্থী উৎসবের শিকড় প্রোথিত রয়েছে হিন্দুত্ব স্বরাজ মারাঠা সাম্রাজ্যে, যেখানে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এই উৎসবকে হিন্দু ঐক্য ও ভক্তি প্রচারের জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনামলে লোকমান্য তিলক গণেশ চতুর্থীকে একটি গণউৎসবে রূপান্তরিত করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে একত্রিত করা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করা। আজও এই উৎসব কেবল ভক্তি প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি মিলন, সাংস্কৃতিক গর্ব এবং জাতীয় একতার প্রতীক।
Ganesh Chaturthi : বাম, ডান নাকি সোজা ? শুঁড়ের দিকভেদে শ্রী গনেশের বিভিন্ন রূপ ও তাদের তাৎপর্য
আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান:
গণেশ চতুর্থী উৎসবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, যার গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ রয়েছে:
- ১. প্রাণপ্রতিষ্ঠা: এই উৎসবের সূচনা হয় ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’র মাধ্যমে, যেখানে মন্ত্রোচ্চারণ এবং প্রার্থনার মাধ্যমে ভগবান গণেশকে মূর্তিতে আবাহন করা হয়। পুরোহিতরা বৈদিক মন্ত্র দ্বারা দেবত্বকে মূর্তিতে আহ্বান জানান, যা প্রতিমাকে একটি পবিত্র সত্তায় রূপান্তরিত করে। এটি ভক্তদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে যে গণেশ তাঁদের গৃহে বা মণ্ডপে আশীর্বাদ বর্ষণ করতে এসেছেন।
- ২. ষোড়শোপচার: প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর ষোড়শোপচার পূজা করা হয়। এতে ফুল, ধূপ, দীপ, মিষ্টি, ফল এবং প্রার্থনা সহ মোট ষোল প্রকারের নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। প্রতিটি নৈবেদ্য ভক্তি, পবিত্রতা এবং ভগবান গণেশের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। এটি একজন ঐশ্বরিক অতিথিকে অত্যন্ত যত্ন ও আতিথেয়তার সঙ্গে স্বাগত জানানোর ধারণা প্রতিফলিত করে।
- ৩. উত্তরপূজা: গণেশ বিসর্জনের আগে ‘উত্তরপূজা’ করা হয়। এই আচারের মাধ্যমে ভক্তরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং উৎসব চলাকালীন ঘটে যাওয়া যেকোনো ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। প্রতীকীভাবে, এটি ভগবানকে তাঁর স্বর্গীয় আবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা বোঝায়, যিনি উৎসবের পুরোটা সময় ধরে ভালোবাসা ও ভক্তি সহকারে সম্মানিত হয়েছেন।
- ৪. বিসর্জন: উৎসবের সমাপ্তি ঘটে ‘বিসর্জন’-এর মাধ্যমে, যেখানে গণেশের প্রতিমা জলে নিমজ্জিত করা হয়। এই আচারটি সৃষ্টি এবং বিলয়ের চক্রকে নির্দেশ করে – যা ভক্তদের জীবনের অস্থিরতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি ভগবান গণেশের তাঁর স্বর্গীয় আবাসে ফিরে যাওয়ার প্রতীক, এই প্রার্থনা সহকারে যে তিনি পরের বছর আবার ফিরে আসবেন।
ঐক্য ও আধ্যাত্মিক বৃদ্ধির বার্তা:
গণেশ চতুর্থী কেবল ভক্তি প্রদর্শনের উৎসব নয়, এটি সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং আনন্দেরও উৎস। বিশ্বাস করা হয় যে এই দশ দিন ধরে ভগবান গণেশ পৃথিবীতে আসেন তাঁর ভক্তদের জ্ঞান, সমৃদ্ধি এবং বাধা অতিক্রম করার শক্তি দিয়ে আশীর্বাদ করার জন্য। এই উৎসব একতা, বিনয় এবং আধ্যাত্মিক বৃদ্ধির বার্তা ছড়িয়ে দেয়। প্রতিটি বাঙালি পরিবার এবং শহরবাসীর জন্য এই দিনটি এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের আগমনে সকলের জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আসে।