ব্যুরো নিউজ ২০ অক্টোবর ২০২৫ : হিন্দু ঐতিহ্যে মহাদেব শিবকে প্রায়শই দুটি আপাতবিরোধী নামে সম্বোধন করা হয়: ভোলেবাবা (Bholenath), অর্থাৎ পরম সরল, কপটতাশূন্য প্রভু, এবং রুদ্র (Rudra), অর্থাৎ ভয়ঙ্কর, যিনি প্রলয়ের রূপ। কীভাবে একই দেবত্ব এইরকম চরম বৈপরীত্যকে ধারণ করতে পারে? এই বিষয়টি অনুধাবন করা কোনো বিরোধের মীমাংসা নয়, বরং জীবন এবং পরম সত্যকে সামগ্রিকভাবে বোঝা।
সরলতার সারমর্ম: ভোলেবাবা
হিন্দিতে ‘ভোলা’ শব্দের অর্থ হলো সরল হৃদয়ের, কোনো কূটকৌশল বা গোপন অভিসন্ধি মুক্ত। পুরাণ জুড়ে এমন অসংখ্য গল্প রয়েছে যেখানে শিব সামান্যতম ভক্তিতেই সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং অতি সহজে বর দান করে দেন—কখনও কখনও অসুরদেরও। তিনি ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি বা বাহ্যিক আড়ম্বরে সম্পূর্ণ উদাসীন। কৈলাস পর্বতে তাঁর জীবন অতি সাধারণ; মাথার উপরে আকাশ আর সর্বাঙ্গে চিতার ভস্মই তাঁর ভূষণ। তিনি ভক্তের সামান্যতম অর্ঘ্যে, একটি বেলপাতা বা এক ফোঁটা জলেও তুষ্ট হন।
শিবের এই সারল্য দুর্বলতা নয়; এটি বিশুদ্ধতা। শিব কোনো হিসাব করেন না, কোনো দর কষাকষি করেন না। তিনি আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত বলেই মুক্ত হৃদয়ে সবকিছু গ্রহণ করেন। তাঁর এই ভোলা স্বভাব আমাদের একটি মৌলিক সত্য দেখায়: ঈশ্বর কোনো কিছুকে জটিল করেন না; জটিলতা সৃষ্টি করি আমরাই।
সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ
সত্যের অনিবার্য রোষ: ভয়ঙ্কর রুদ্র
অথচ, এই একই প্রভু রুদ্র, যিনি গর্জন করেন, যার ক্রোধে ত্রিপুরাসুরের তিনটি শহর এক তীরে ভস্মীভূত হয়, যাঁর তৃতীয় নয়নের আগুনে কামদেব, অর্থাৎ কামনার দেবতাও, ধোঁয়ায় পরিণত হন। এই ভয়াল রূপ কেন?
কারণ, শিব হলেন মহাকাল (Mahakaal), অর্থাৎ স্বয়ং কাল বা সময়। আর কাল কাউকে রেহাই দেয় না। প্রতিটি রূপ, প্রতিটি অহংকার, প্রতিটি আসক্তিকে অবশেষে কালের কাছে নত হতেই হয়। যে মায়া বা মিথ্যার জালে আবদ্ধ থাকতে চায়, তার কাছে শিবের এই রুদ্ররূপ ভয়ঙ্কর। আর যে মুক্তি পেতে প্রস্তুত, তার কাছে তিনি পরম মুক্তিদাতা। তাঁর এই রুদ্ররূপের বিপদ কোনো স্বেচ্ছাচারী নিষ্ঠুরতা নয়, বরং এটি হলো সত্যের অবশ্যম্ভাবিতা। তিনি কেবল মিথ্যাকেই ধ্বংস করেন।
শাস্ত্রের শিক্ষা ও অখণ্ডতার বার্তা
যজুর্বেদের শ্রী রুদ্রম স্তোত্রে তাঁকে একই সঙ্গে ‘ভয়ঙ্কর’ (ঘোরা) এবং ‘শুভঙ্কর’ (শিব) বলা হয়েছে। শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ রুদ্রকে এক অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে বর্ণনা করে—যিনি সকল সৃষ্টির উৎস এবং সকল কিছুর বিলয়কারী। পুরাণগুলিতে তিনি একদিকে যেমন গভীর ধ্যানে মগ্ন সন্ন্যাসী, তেমনই অন্যদিকে সৃষ্টি ও বিনাশকারী তাণ্ডবনৃত্যরত নটরাজ (Nataraja)।
এগুলি কোনো বিরোধ নয়, বরং পূর্ণতার প্রতীক। শিব আমাদের কোমল বনাম কঠোর, নিরাপদ বনাম বিপজ্জনক—এইসব মানবিক শ্রেণীবিন্যাসে আবদ্ধ হন না। তিনি অস্তিত্বের পূর্ণতাকে ধারণ করেন—জন্ম ও মৃত্যু, আশীর্বাদ ও বিনাশ, নীরবতা ও বজ্রনাদ।
Brahma ; সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সীমিত উপাসনা: এক বিস্ময়কর রহস্য !
আমাদের জীবনে এর তাৎপর্য
যখন আমরা শিবকে ‘পরম সরল’ বলি, তখন আমাদের মনে পড়ে জীবনকে বিশুদ্ধতা দিয়ে গ্রহণ করার কথা, গোপন উদ্দেশ্য বা লোভ ছাড়াই চলার কথা। আর যখন আমরা তাঁকে ‘পরম বিপজ্জনক’ বলি, তখন আমাদের মনে আসে যে আমাদের ভিতরের সমস্ত মিথ্যা—অহংকার, আসক্তি, বিভ্রম—কিছুতেই টিকে থাকবে না। এই কারণেই শিব একইসঙ্গে ভালোবাসার পাত্র এবং ভয়ের কারণ। তাঁকে ভালোবাসা মানে রূপান্তরকে স্বাগত জানানো; তাঁকে ভয় পাওয়া মানে এই রূপান্তরকে প্রতিহত করা। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই তিনি কেবল সত্য।
যে সাধক ধ্যানের পথে হেঁটেছেন, নীরবতার সঙ্গে বসেছেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যেই শিবের এই দুই রূপকে জানতে পারেন। এমন মুহূর্ত আসে যখন হৃদয়ে গভীর সারল্য অনুভূত হয়, মন হয় হালকা ও মুক্ত। আবার ঠিক তখনই সেই নীরবতা চরম মূল্য দাবি করে—বিভ্রম ভেঙে যায়, মিথ্যা নিরাপত্তাগুলি ধূলিসাৎ হয়, অহংকারের দহন হয়। এটি ভয়ঙ্কর মনে হলেও, এটিই আসলে কৃপা।
শিব আমাদের মনে করিয়ে দেন: যা বাস্তব, তাকে আঘাত করা যায় না; আর যা ধ্বংস হতে পারে, তা বাস্তব নয়। সেই কারণেই তিনি ভোলে—সরল, সহজ, সর্বদা দানশীল। এবং সেই কারণেই তিনি রুদ্র—ভয়ঙ্কর, অপ্রতিরোধ্য, অনিবার্য।



















