ব্যুরো নিউজ ১৭ অক্টোবর ২০২৫ : নবরাত্রি কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের উৎসব নয়; এটি উপস্থিতির উৎসব। নয়টি রাত ধরে ভারতজুড়ে কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করেন যে, দেবী কেবল গল্প বা ধর্মগ্রন্থে লুকিয়ে থাকেন না, বরং এমনভাবে আমাদের জগতে পদার্পণ করেন, যা অনুভব করা যায়। সন্ধ্যার আলোয় ঘণ্টার শব্দ, ঢোলের ছন্দ, এবং প্রদীপের উজ্জ্বল আভা—সবকিছুতেই যেন তাঁর পবিত্র স্পর্শ অনুভব করা যায়।
এই নয় দিনে প্রতিটি বাড়ি এক একটি ছোট মন্দিরে পরিণত হলেও, এমন কিছু পবিত্র স্থান আছে যেখানে দেবীর শক্তি তাঁর বিশুদ্ধতম রূপে জীবন্ত হয়ে ওঠে বলে বিশ্বাস করা হয়। এইগুলি সেইসব পুণ্যভূমি, যেখানে ঐতিহ্য অনুসারে নবরাত্রির সময় দেবী সবথেকে শক্তিশালীভাবে জাগ্রত হন। এই স্থানগুলিতেই বিশ্বাস এক গভীর অভিজ্ঞতায় পরিবর্তিত হয়, এবং পৌরাণিক কাহিনী, ভক্তি এবং ইতিহাস এক প্রাচীন ও জীবন্ত সত্তায় মিশে যায়।
দেবীর জীবন্ত অস্তিত্বের সাতটি তীর্থক্ষেত্র
এখানে এমন সাতটি মন্দিরের কথা বলা হলো, যেখানে নবরাত্রির সময় ভক্তরা দেবীর জীবন্ত শক্তি অনুভব করেন:
১. বৈষ্ণো দেবী মন্দির, জম্মু ও কাশ্মীর
জম্মু-কাশ্মীরের কাটরা সংলগ্ন ত্রিকুটা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বৈষ্ণো দেবী মন্দির ভারতের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান। নবরাত্রির সময় পুরো অঞ্চলটি এক অতুলনীয় আধ্যাত্মিক উদ্দীপনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। এখানে দেবী বৈষ্ণবী মাতা রূপে প্রকাশিত হন, যিনি স্বয়ং মহালক্ষ্মীর অবতার। গুহার অভ্যন্তরে, দেবী মহাকালী, মহালক্ষ্মী এবং মহাসরস্বতী—এই তিনটি পিণ্ডি রূপে পূজিত হন। বিশ্বাস করা হয় যে এই নয় রাতে দেবী তাঁর আশীর্বাদ আরও তীব্রভাবে বর্ষণ করেন, ভক্তদের আধ্যাত্মিক শক্তি ও বস্তুগত পূর্ণতা দান করেন।
Shaktipeeth : সতী ও ৫১ শক্তিপীঠ: এক শাশ্বত গাথা
২. চামুণ্ডা দেবী মন্দির, হিমাচল প্রদেশ
হিমাচল প্রদেশের কাংড়ার কাছে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দিরটি দেবী চামুণ্ডার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। চামুণ্ডা হলেন দেবী দুর্গার এক উগ্র রূপ, যিনি চণ্ড ও মুণ্ড অসুরকে বিনাশ করেছিলেন। নবরাত্রিতে এখানে দুর্গাসপ্তশতী পাঠ এবং দেবীর রক্ষাকারী শক্তিকে আহ্বান জানানোর জন্য বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, নবরাত্রির সময় স্বয়ং চামুণ্ডা এই মন্দিরে আবির্ভূতা হন এবং অঞ্চল ও তাঁর উপাসকদের নেতিবাচকতা থেকে রক্ষা করেন।
৩. কামাখ্যা মন্দির, আসাম
গুয়াহাটির নীলাচল পাহাড়ের উপরে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তিপীঠ। এই মন্দিরটি দেবী সতীর যোনি (গর্ভ)-কে উৎসর্গীকৃত, যা ঐশ্বরিক নারীশক্তি ও উর্বরতার প্রতীক। যদিও এই স্থান অম্বুবাচী মেলার জন্য বিখ্যাত, তবুও নবরাত্রি হল সেই সময় যখন দেবী এখানে বিশেষভাবে প্রাণবন্ত হন বলে বিশ্বাস করা হয়। এখানে শক্তি-র সৃজনশীল এবং পুনর্জন্মের দিকগুলিকে আহ্বান জানানোর উপর মনোযোগ দেওয়া হয়, যা ভক্তদের মনে করিয়ে দেয় যে দেবীই জীবনের চিরন্তন উৎস।
৪. দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, পশ্চিমবঙ্গ
হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির একটি প্রধান আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, যা শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। নবরাত্রির সময়, বিশেষ করে মহা অষ্টমী এবং মহানবমীর দিনে, মন্দিরটি ভক্তির এক উজ্জ্বল কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে দেবী ভবতারিণী রূপে পূজিত হন, যিনি জগৎ সংসারের মুক্তিদাতা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে এই নয় দিনে কালীর ঐশ্বরিক উপস্থিতি তীব্র হয়, যা সাধকদের জাগতিক মায়া অতিক্রম করে মুক্তি বা মোক্ষের দিকে চালিত করে।
৫. অম্বা জি মন্দির, গুজরাট
গুজরাট-রাজস্থান সীমান্তের কাছে অবস্থিত অম্বা জি মন্দির ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি। এই মন্দিরে কোনো মূর্তি নেই, বরং দেবীকে যন্ত্র রূপে পূজা করা হয়। নবরাত্রির সময় মন্দিরটি ভক্তিমূলক সঙ্গীত, ঐতিহ্যবাহী গরবা নৃত্য এবং আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে এই দিনগুলিতে অম্বা জি-র উপস্থিতি বিশেষভাবে শক্তিশালী হয় এবং সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য তাঁর আশীর্বাদ চাওয়া হয়। এখানে কোনো মূর্তির অনুপস্থিতি শক্তির নিরাকার এবং চিরন্তন দিককে তুলে ধরে।
৬. ছত্তরপুর মন্দির, দিল্লি
দিল্লির ছত্তরপুর মন্দির, দেবী কাত্যায়নীকে উৎসর্গীকৃত, এটি ভারতের বৃহত্তম মন্দির কমপ্লেক্সগুলির মধ্যে অন্যতম। নবরাত্রি এই আধুনিক মন্দিরটিকে লক্ষ লক্ষ ভক্তের মিলনক্ষেত্রে রূপান্তরিত করে। নবদুর্গার অন্যতম রূপ দেবী কাত্যায়নীকে এখানে বিশেষ আচার, প্রার্থনা এবং স্তোত্র পাঠের মাধ্যমে আহ্বান করা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, এই নয় দিনে দেবীর শক্তি বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে, যা জীবনে আসা সমস্ত বাধা দূর করতে এবং সাহস যোগাতে সাহায্য করে।
Maa Durga : বিসর্জন নয়, মাতৃ শক্তিকে স্মরণ : বিজয়া দশমীর পর কীভাবে মা দুর্গার কৃপা ধরে রাখবেন
৭. জ্বালামুখী মন্দির, হিমাচল প্রদেশ
চিরন্তন শিখার মন্দির নামে পরিচিত জ্বালামুখী মন্দির অন্যতম অনন্য শক্তিপীঠ। এখানে দেবী পূজিত হন শিখার রূপে, যা প্রাকৃতিকভাবে পাথরের ফাটল থেকে নির্গত হয়। নবরাত্রির সময়, এই শিখাগুলিকেই দেবীর জীবন্ত উপস্থিতি হিসাবে দেখা হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, সতীর জিহ্বা এই স্থানে পড়েছিল, যা তাঁর অগ্নিময় এবং গ্রাসকারী শক্তিকে প্রতীকায়িত করে। নবরাত্রির আচার-অনুষ্ঠান এই বিশ্বাসকে আরও তীব্র করে তোলে, যখন ভক্তরা দেবীর এই তেজময় রূপের সাক্ষী হতে ছুটে আসেন।
যেখানে বিশ্বাস জীবন্ত শক্তির সাথে মিলিত হয়
নবরাত্রি কেবল নয় রাতের আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং নয়টি রাত যখন জগজ্জননী জাগ্রত হন এবং তাঁর ভক্তদের মধ্যে বিচরণ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। এই পবিত্র মন্দিরগুলি কেবল পাথর নয়, এগুলি জীবন্ত আশ্রয়স্থল যেখানে শক্তি নিঃশ্বাস নেয়, যেখানে পৌরাণিক কাহিনী আর বিশ্বাস অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। নবরাত্রিতে এই পবিত্র স্থানগুলিতে উপস্থিত থাকা মানে দেবীকে অনুভব করা; তিনি নীরবতাকে মন্ত্রে, আলোকে শক্তিতে এবং ভক্তিকে আশীর্বাদে রূপান্তরিত করেন। এই তীর্থস্থানগুলিতে যাত্রা হোক বা ঘরে একটি সাধারণ প্রদীপ জ্বালানো হোক—সত্য এটাই: শক্তি জীবন্ত, উজ্জ্বল এবং সর্বদা আমাদের নাগালের মধ্যে।