ব্যুরো নিউজ ,৭ মে: পাকিস্তানের মাটিতে তাণ্ডব চালিয়ে গেল ভারতীয় বাহিনী। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে চালানো এই অভিযানে পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের একাধিক জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারত। নিশানা ছিল বিশেষভাবে জইশ-ই-মহম্মদের গড়—পাকিস্তানের বহওয়ালপুর শহর। এই স্ট্রাইকে নিহত হয়েছেন জইশ প্রধান মৌলানা মাসুদ আজ়হারের পরিবারের ১০ জন, যার মধ্যে রয়েছেন তার বোন এবং শ্যালকও।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, বহওয়ালপুর শহরের উপকণ্ঠে রয়েছে জইশের মূল সদর দফতর। এখানেই ‘জামিয়া মসজিদ শুভান আল্লাহ্’ ক্যাম্পাসে চলে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ এবং হামলার ছক। মাসুদ আজ়হার নিজেও এই ক্যাম্পাসে দীর্ঘ দিন ছিলেন। ফলে এই এলাকা ছিল অপারেশন সিঁদুরের প্রাথমিক লক্ষ্য।
মঙ্গলবার রাত ১টা থেকে শুরু হয়ে দেড়টার মধ্যেই মাত্র ২৫ মিনিটে আঘাত হানা হয় পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের মোট ২১টি জঙ্গি ঘাঁটিতে। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে জঙ্গিদের গোপন আস্তানা। পাক সেনা মুখপাত্রও এই হামলার কথা স্বীকার করেছেন। যদিও পাকিস্তান দাবি করেছে, হামলায় সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, জইশ ঘাঁটিতে মারা গেছেন মাসুদ আজ়হারের পরিবারের ১০ সদস্য। তবে কিছু সূত্রে দাবি, এই সংখ্যা ১৪। নিহতদের মধ্যে মাসুদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাও রয়েছেন। হামলার পরে মাসুদ আজ়হার নিজেই এক বিবৃতি দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে তিনি দাবি করেন, তার এই ক্ষতিতে কোনও অনুশোচনা নেই।
এখন বড় প্রশ্ন—এই হামলায় কি মাসুদ আজ়হার নিজেও নিহত হয়েছেন? বহু দিন ধরেই ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা আজ়হারের গতিবিধি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরেও চর্চা চলছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ ইতিমধ্যেই তাঁকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে এই হামলার পর আজ়হারের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। পাকিস্তান সরকারও তার জীবিত থাকা বা নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের শেষদিকে বহওয়ালপুরের ওই ক্যাম্পাসে ফের দেখা গিয়েছিল মাসুদ আজ়হারকে। তখনই ভারতীয় গোয়েন্দারা তাঁর গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখছিলেন। এই তথ্যের ভিত্তিতেই নিশানা বানানো হয় বহওয়ালপুরের জইশ ঘাঁটিকে। সেখানেই সম্ভবত নতুন করে ভারতে হামলার ছক কষছিলেন আজ়হার।
অপারেশন সিঁদুর শুধু বহওয়ালপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের কোটলি শহরেও স্ট্রাইক চালিয়েছে ভারতীয় বিমান বাহিনী। সেই হামলায় নিহত হন লশকর-এ-তৈবার শীর্ষ ধর্মীয় প্রচারক মহম্মদ ইকবাল। ভারতের দাবি, এই অভিযানে একমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিকেই নিশানা করা হয়েছে, কোনও সাধারণ নাগরিক আক্রান্ত হননি।
প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপরে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান ২৬ জন। এই হামলার পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানকে দায়ী করে কঠোর পদক্ষেপের বার্তা দেন। সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয় পূর্ণ স্বাধীনতা। অপারেশন সিঁদুর সেই নির্দেশেরই ফল।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ ইতিমধ্যেই ভারতের এই হামলার জবাবে পাল্টা প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তবে ভারতের স্পষ্ট দাবি, এই হামলায় পাকিস্তানি সেনা পরিকাঠামো নয়, শুধুমাত্র জঙ্গি ঘাঁটিই টার্গেট করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বহওয়ালপুরের জইশ সদর দফতরে এই ধরণের বড়সড় হামলা নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর জন্য বড় ধাক্কা। কারণ বহওয়ালপুর শহরকে জইশের হৃদপিণ্ড বলা হয়। এখান থেকেই ২০০১ সালের সংসদ হামলা, ২০১৬ সালের পঠানকোট বিমানঘাঁটি হামলা এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার মতো ঘটনাগুলির ছক কষা হয়েছিল।
এবারের অপারেশনের পর আন্তর্জাতিক মহলও নজর রাখছে এই অঞ্চলের উপর। মাসুদ আজ়হারের জীবিত থাকা না থাকার বিষয়টিও আগামী দিনে এই অঞ্চলের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতীয় বাহিনী এই অভিযান চালিয়ে শুধু পাকিস্তানকে বার্তা দিল না, বরং সীমান্ত সন্ত্রাসবাদ দমনে নিজেদের কঠোর মনোভাবও আন্তর্জাতিক মহলের সামনে স্পষ্ট করল। এখন গোটা বিশ্বের নজর পাকিস্তানের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং মাসুদ আজ়হারের ভাগ্য নিয়ে।