ব্যুরো নিউজ,৩১ ডিসেম্বর:কালনা, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি প্রাচীন শহর, যাকে ‘মন্দিরের শহর’ বলা হয়। এই শহরের প্রতি কোণে কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির, প্রতিটি মন্দিরের নিজস্ব ইতিহাস ও শৈলী। কলকাতা থেকে প্রায় দু’ঘণ্টার পথের ব্যবধানে কালনা পৌঁছালে, মনে হবে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক পৃথিবী থেকে আপনি শতাব্দীখানেক পিছিয়ে গিয়েছেন। এই শহরের প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সবার মন ছুঁয়ে যায়। কালনা শুধু মন্দিরের জন্যই নয়, বরং এটি একটি ইতিহাসের শহর হিসেবেও পরিচিত।
শীতের মরসুমে বেড়ানোর আদর্শ স্থান কচ্ছের রণ। চলুন ঘুরে আসি
কালনার ইতিহাস
কালনার ইতিহাস জানার জন্য, আপনাকে ষষ্ঠ শতকের কুব্জিকা তন্ত্র বইয়ের উল্লেখ করতে হবে, যেখানে প্রথমবার অম্বিকা কালনার নাম আসে। সপ্তম শতকে, বাংলার রাজা শশাঙ্কের শাসনকালে কালনা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর, যা তাম্রলিপ্তের অংশ ছিল। তাম্রলিপ্তকে মহাভারতেও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কালনার প্রকৃত সমৃদ্ধি আসে ১৮শ শতকে বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্র রাইয়ের শাসনকালে, যখন তিনি অনেক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।কালনার নাম নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে, অম্বিকা কালনার নামটি এসেছে অম্বিকা দেবী, যিনি দেবী দুর্গার আরেক রূপ। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, অম্বিকা কালনার নামটি জৈন ধর্মের দেবী অম্বিকার নাম থেকে এসেছে।
কালনায় দেখার মতো স্থান:
১. নবকৈলাস মন্দির (১০৮ শিবের মন্দির):
কালনার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো ১০৮ শিবের মন্দির। এই মন্দিরটি ১৮০৯ সালে বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর নির্মাণ করেন। মন্দিরের শৈলী অত্যন্ত সুন্দর এবং এখানে শিবলিঙ্গের ১০৮টি মূর্তি রয়েছে, যা অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এবং দর্শনীয়।
২. রাজবাড়ি চত্বর:
কালনার রাজবাড়ি চত্বর এক উন্মুক্ত স্থানে অবস্থিত। এখানে রয়েছে নানা মন্দির, যেমন প্রতাপেশ্বর মন্দির, রাসমঞ্চ, লালজিউ মন্দির, গিরিগোবর্ধন মন্দির। প্রতাপেশ্বর মন্দিরে রয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনির চিত্রকর্ম, যা দেখতে খুবই সুন্দর। রাসমঞ্চে বৈষ্ণব উৎসব পালিত হত।
কলকাতার কাছে দু’দিনের ছুটিতে ঘুরে আসুন পুষ্পবন ও দেউলটি
৩. সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির:
এটি একটি জোড়া বাংলা মন্দির, যেখানে অম্বিকা দেবীর পূজা করা হত। মন্দিরের ভিতরে টেরাকোটা কাজ রয়েছে, যা দেখার মতো।
৪. ভবা পাগলার মন্দির:
কালনায় শাক্ত উপাসক ভবা পাগলার জন্য বিখ্যাত একটি মন্দির রয়েছে। এখানে ভবা পাগলার কালী আরাধনা স্থানের কাছে পাতালগঙ্গা রয়েছে, যা ধর্মীয় দর্শনার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৫. জগন্নাথবাড়ি:
এটি ১৭৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি মন্দির, যার দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্রকর্ম রয়েছে। মন্দিরের গায়ে পর্তুগিজ যুদ্ধজাহাজ, ইংরেজদের ঘোড়সওয়ার বাহিনী এবং রাজাদের হাতি সওয়ার বাহিনীর যুদ্ধের দৃশ্য চিত্রিত রয়েছে।
কালনায় কীভাবে পৌঁছাবেন:
কালনা পৌঁছাতে সড়ক এবং রেলপথ দুটি সহজ পদ্ধতি। সড়কপথে কলকাতা থেকে প্রায় ৯৭ কিলোমিটার পথ পার করে কালনায় পৌঁছানো যায়। যশোর রোড বা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সহজেই পৌঁছানো সম্ভব। রেলপথে শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে কাটোয়াগামী ট্রেনে চড়ে অম্বিকা কালনা স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো করে মন্দির শহরের কেন্দ্রে পৌঁছানো যায়।
কলকাতার একেবারে কাছেই ঘুরে আসুন একদিনের জন্য বাঁকিপুটের শান্ত পরিবেশে
কালনার খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা:
কালনার মিষ্টির জন্য খুবই জনপ্রিয়। এখানে মাখা সন্দেশ, জোড়া সন্দেশ, নোড়া পান্তুয়া, ছানার মুড়কি এবং শীতকালে নলেন গুড় খেতে ভুলবেন না। খাবারের জন্য শহরের ছোট ছোট রেস্তরাঁ বা মন্দির চত্বরের কাছাকাছি জায়গাগুলোতে গিয়ে খাবার খেতে পারেন।থাকার জন্য কালনায় কিছু মাঝারি মানের হোটেল রয়েছে, তবে বেশিরভাগ পর্যটক সাধারণত একদিনে সফর করে ফিরে যান।কালনা, ইতিহাস এবং মন্দিরের এক চমৎকার মিশ্রণ, যা আপনাকে এক নতুন পৃথিবীতে নিয়ে যাবে।