সৌরভ রায় চৌধুরী , ২৬ জুলাই ২০২৫ : এই প্রতিবেদনটি পশ্চিমবাংলায় বজরংবলী (হনুমান) পূজার উৎস এবং ঐতিহাসিক বিকাশ নিয়ে একটি বিশদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। পশ্চিমবাংলায় হনুমান পূজার নির্দিষ্ট “প্রথম” স্থান বা মন্দির চিহ্নিত করা ঐতিহাসিকভাবে চ্যালেঞ্জিং, কারণ প্রাথমিক সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক এবং লিখিত প্রমাণ সীমিত। তবে, এই গবেষণাটি এমন মূল সময়কাল এবং প্রভাবগুলি তুলে ধরেছে যা এই অঞ্চলে হনুমান ভক্তির ব্যাপক জনপ্রিয়তার দিকে পরিচালিত করেছে, বিশেষ করে মধ্যযুগ থেকে।
মূল অনুসন্ধানগুলি নির্দেশ করে যে, ১৪শ-১৫শ শতাব্দীর বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা রচিত কৃত্তিবাসী রামায়ণ হনুমান উপাসনার প্রসারে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করেছিল। কলকাতা রাজা কাটরা হনুমান মন্দির এবং কালিম্পং হনুমান মন্দির (একটি শতাব্দী প্রাচীন কাঠামোর প্রতিরূপ) এর মতো বিদ্যমান প্রাচীন মন্দিরগুলি এই পূজার প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রগুলিকে প্রতিনিধিত্ব করে, যদিও তাদের “প্রথম” পূজার সঠিক প্রতিষ্ঠার তারিখগুলি নির্ধারণ করা কঠিন। হনুমানের শারীরিক সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক এবং রক্ষক হিসাবে তাঁর সমন্বিত ভূমিকা, প্রায়শই কালী দেবীর মতো স্থানীয় দেবীর সাথে যুক্ত, বাংলায় তাঁর অনন্য ধর্মীয় অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই প্রতিবেদনটি বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্যের গতিশীল এবং অভিযোজনযোগ্য প্রকৃতিকে তুলে ধরে, যেখানে প্রাচীন বিশ্বাসগুলি আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক প্রকাশের সাথে মিশে গেছে।
১. ভূমিকা: বাংলায় হনুমানের চিরন্তন উপস্থিতি
ভগবান হনুমান হিন্দু ধর্মে এক অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় দেবতা, যিনি তাঁর অসামান্য শক্তি, ভগবান রামের প্রতি অবিচল ভক্তি, গভীর আনুগত্য এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিচিত। তিনি রামায়ণের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং হিন্দু ভক্তদের কাছে বাধা অতিক্রমের প্রতীক হিসাবে পূজিত হন। তাঁর চরিত্রটি প্রায়শই একজন আদর্শ ভক্তের উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপিত হয়, যিনি নিজের ক্ষমতাকে অন্যের সেবায়, বিশেষ করে তাঁর প্রভু রামের সেবায় নিয়োজিত করেন।
পশ্চিমবাংলা, ভারতের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি রাজ্য, তার নিজস্ব স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জন্য পরিচিত। এই অঞ্চলে বৈষ্ণব, শাক্ত এবং বিভিন্ন লোক ঐতিহ্য সহ বহু ধর্মীয় স্রোত প্রবাহিত হয়েছে, যা এর ধর্মীয় ল্যান্ডস্কেপকে সমৃদ্ধ করেছে। এই বৈচিত্র্যময় প্রেক্ষাপটে হনুমান উপাসনার বিকাশ এবং বিস্তার একটি আকর্ষণীয় গবেষণার বিষয়।
পশ্চিমবাংলায় ঠিক কোন স্থানে এবং কখন “প্রথম” বজরংবলী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা অত্যন্ত কঠিন। প্রাথমিক সময়ের ঐতিহাসিক নথি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এই বিষয়ে সীমিত। এই প্রতিবেদনটি এই ঐতিহাসিক শূন্যতা পূরণ করার পরিবর্তে, বাংলায় হনুমান উপাসনার ঐতিহাসিক বিবর্তন, তাঁর পূজার প্রাচীনতম পরিচিত কেন্দ্রগুলি এবং যে সকল সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভাবক তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল, সেগুলির উপর আলোকপাত করবে। এর মাধ্যমে, পশ্চিমবাংলায় হনুমান ভক্তির একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হবে।
Hanumanji : ভারতের যেসব স্থানে বজরং স্মৃতি এবং উপস্থিতি এখনও অবিচল !
২. ভারতে হনুমান উপাসনার ঐতিহাসিক গতিপথ
হনুমান উপাসনার ইতিহাস ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তর ধর্মীয় বিবর্তনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। তাঁর ঐশ্বরিক মর্যাদা এবং জনপ্রিয়তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, যা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের দ্বারা প্রভাবিত।
২.১. প্রাথমিক বৈদিক উল্লেখ এবং ঐশ্বরিক মর্যাদার বিবর্তন
ঐশ্বরিক বানরের প্রাচীনতম উল্লেখ, যা কিছু পণ্ডিত প্রোটো-হনুমান হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ঋগ্বেদের ১০.৮৬ সূক্তে পাওয়া যায়। এই সূক্তটি ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত বলে ধারণা করা হয়। এটি একটি রূপক এবং ধাঁধাময় কিংবদন্তি, যা দেবতা ইন্দ্র, তাঁর স্ত্রী ইন্দ্রাণী এবং বৃষাকপি নামক একটি উদ্যমী বানরের মধ্যে সংলাপ হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই উল্লেখ বানর পূজার একটি প্রাচীন রূপের ইঙ্গিত দেয়, যদিও এটি সরাসরি বর্তমান হনুমান উপাসনার সাথে সম্পর্কিত নাও হতে পারে।
হনুমানের উল্লেখ হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণেও পাওয়া যায়। কিছু গ্রন্থে তাঁকে শিবের অবতার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে বায়ু দেবতার আধ্যাত্মিক পুত্র বা বায়ুর অবতার হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিভিন্ন উল্লেখগুলি হনুমানের চরিত্র এবং তাঁর ঐশ্বরিক পরিচয় সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য এবং ব্যাখ্যার অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
২.২. ভক্তি ঐতিহ্যের উত্থান এবং হনুমানের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব
হনুমানের ধর্মতাত্ত্বিক তাৎপর্য এবং তাঁর প্রতি ভক্তিমূলক উপাসনা মূলত ২য় সহস্রাব্দ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে বিকশিত হয়, যা রামায়ণ রচনার প্রায় ১,০০০ বছর পরের ঘটনা। তাঁর জনপ্রিয়তা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায় ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামিক শাসনের আগমনের পর, যেখানে তিনি প্রতিরোধ এবং নিষ্ঠার প্রতীক হয়ে ওঠেন। এই সময়কালে, তিনি শক্তি (“শক্তি, বীরত্বপূর্ণ উদ্যোগ এবং দৃঢ় শ্রেষ্ঠত্ব”) এবং ভক্তি (“তাঁর ব্যক্তিগত দেবতা রামের প্রতি প্রেমময়, আবেগপূর্ণ ভক্তি”) এর আদর্শ সমন্বয় হিসাবে বিবেচিত হন।
হনুমানের মর্যাদা বৈদিক যুগের “ঐশ্বরিক বানর” থেকে শক্তি ও ভক্তির এক বিশিষ্ট দেবতায় রূপান্তরিত হওয়া হিন্দু ধর্মীয় অনুশীলনে একটি বৃহত্তর পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। এই পরিবর্তন ব্যক্তিগত ভক্তি (ভক্তি আন্দোলন) এবং একটি শক্তিশালী রক্ষক চিত্রের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়, বিশেষ করে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়কালে। এই জাতীয় প্রবণতা অনিবার্যভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পূজা পদ্ধতিকেও প্রভাবিত করেছে, যার মধ্যে বাংলাও অন্তর্ভুক্ত।
২.৩. বৃহত্তর প্রভাব
হনুমানের এই ঐতিহাসিক বিবর্তন কেবল তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেনি, বরং এটি বৃহত্তর হিন্দু সমাজের ধর্মীয় কাঠামোতেও পরিবর্তন এনেছে। তাঁর চরিত্রটি ভক্তদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে, যা তাঁদেরকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, সেবা এবং ঈশ্বরের প্রতি অবিচল ভক্তির পথে পরিচালিত করে। এই জাতীয় দেবত্বের উত্থান, যা সাধারণ মানুষের কাছে সহজে প্রবেশযোগ্য এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে সুরক্ষা ও শক্তি প্রদানকারী হিসাবে বিবেচিত হয়, তা আঞ্চলিক উপাসনা পদ্ধতিগুলিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার মধ্যে পশ্চিমবাংলাও ব্যতিক্রম ছিল না।
৩. পশ্চিমবাংলায় হনুমান পূজার উদ্ভব ও বিবর্তন
পশ্চিমবাংলায় হনুমান পূজার সঠিক সূচনা বিন্দু চিহ্নিত করা কঠিন হলেও, বিভিন্ন সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রভাবক তাঁর উপাসনার ব্যাপক প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৩.১. সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবক
কৃত্তিবাসী রামায়ণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা: ১৪শ শতাব্দীর বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ণের সংস্করণ, যা কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা শ্রীরাম পাঁচালী নামে পরিচিত, বাঙালি জনসাধারণের মধ্যে রাম ও হনুমানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে। এই গ্রন্থটি কেবল মূল সংস্কৃত মহাকাব্যের অনুবাদ ছিল না, বরং এটি একটি “পুনর্সৃষ্টি” ছিল যা মহাকাব্যের ঘটনাগুলিকে একটি বাঙালি সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছিল। এর ফলে রাম, সীতা এবং হনুমানের মতো চরিত্রগুলি বাঙালি সমাজের কাছে আরও বেশি বাস্তব এবং লোকনায়ক হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণকে “গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষের বাইবেল” এবং প্রাক-আধুনিক বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় একক গ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করা হত, যা ২১শ শতাব্দীতেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই গ্রন্থের ব্যাপক সহজলভ্যতা এবং সাংস্কৃতিক অনুরণন বাংলায় হনুমান পূজার জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করেছে। এটি হনুমানকে একটি বৃহত্তর, সংস্কৃত-কেন্দ্রিক ঐতিহ্য থেকে বাংলার জনপ্রিয় ভক্তিধারায় নিয়ে আসে। এর আগে, তাঁর উপস্থিতি হয়তো আরও সীমিত বা স্থানীয় ছিল, সম্ভবত অভিজাত ব্রাহ্মণীয় বৃত্তের মধ্যে, কিন্তু কৃত্তিবাস তাঁকে একটি গৃহস্থালী দেবতায় পরিণত করেন, যা তাঁর উপাসনার ভিত্তি স্থাপন করে।
বাঙালি লোকশিল্পে চিত্রণ: বাংলার পট্টচিত্র স্ক্রলগুলিতে হনুমানের ভক্তি চিত্রিত হয়েছে, যেমন তাঁর বুক চিরে রাম ও সীতাকে প্রকাশ করা। এই চিত্রণগুলি ভক্তির একটি দৃশ্যমান রূপক প্রদর্শন করে এবং ইঙ্গিত দেয় যে হনুমান স্থানীয় শিল্প ও গল্প বলার ঐতিহ্যে গভীরভাবে একীভূত হয়েছিলেন।
তুলসীদাসের হনুমান চালিশার প্রভাব: তুলসীদাসের রামচরিতমানস (১৬শ শতাব্দী) কৃত্তিবাসী রামায়ণকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করলেও, তুলসীদাস কর্তৃক রচিত হনুমান চালিশা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভক্তিমূলক স্তোত্র হয়ে ওঠে। এটি পাঠ করলে আশীর্বাদ লাভ হয়, বাধা দূর হয় এবং নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস পায় বলে বিশ্বাস করা হয়। হনুমান চালিশার জনপ্রিয়তা, যদিও এটি বাংলার বাইরে রচিত হয়েছিল, বাংলায় হনুমান ভক্তিমূলক অনুশীলনগুলিতে তাঁর স্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে, কারণ এটি ভারত জুড়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত একটি প্রার্থনা। এটি ধর্মীয় অনুশীলন এবং গ্রন্থগুলির আঞ্চলিক প্রবাহ এবং গ্রহণকে প্রদর্শন করে, যা বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে হনুমানের স্থানকে আরও পাকাপোক্ত করে।
৩.২. ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব
বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব: বৈষ্ণব ঐতিহ্য, যা বিষ্ণু এবং তাঁর অবতারদের (রাম সহ) প্রতি প্রেমময় ভক্তির জন্য পরিচিত, ২য় সহস্রাব্দ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে ভক্তি আন্দোলনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলায় বেশ কয়েকটি বৈষ্ণব গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ভক্তি আন্দোলন, তার সহজলভ্য ভক্তির উপর জোর দিয়ে, হনুমানের জনপ্রিয়তার জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে, বিশেষ করে রামের পরম ভক্ত হিসাবে তাঁর ভূমিকার কারণে। হনুমানকে রামের “আদর্শ ভক্ত” হিসাবে দেখা হয়। যেহেতু বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল, তাই এই আন্দোলনের মধ্যে রাম-ভক্তির উপর জোর দেওয়া স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সবচেয়ে ভক্ত অনুসারী হনুমানের প্রতিও প্রসারিত হয়, যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে তাঁর পূজা ত্বরান্বিত হয়।
সমন্বিত ঐতিহ্য এবং স্থানীয় অভিযোজন: বাংলায় হনুমান উপাসনার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর স্থানীয় দেব-দেবী, বিশেষ করে কালী দেবীর সাথে সমন্বয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণের বাংলা সংস্করণে বলা হয়েছে যে হনুমান কালীকে সন্তুষ্ট করেছিলেন, যিনি তাঁকে তাঁর দ্বারপাল হওয়ার আশীর্বাদ করেছিলেন। বাংলার অনেক কালী মন্দিরে এখনও হনুমান প্রবেশদ্বারে রক্ষক হিসাবে থাকেন। বাংলার শক্তিশালী শাক্ত ঐতিহ্য বিবেচনা করলে, হনুমানকে কালীর সাথে যুক্ত করা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আবেদনকে কেবল বৈষ্ণব অনুসারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং তাঁকে একটি বৃহত্তর, আরও স্থানীয় ধর্মীয় ল্যান্ডস্কেপে একীভূত করেছে। এই সমন্বয়বাদ হনুমানকে বাঙালি লোকধর্মে গভীরভাবে প্রোথিত করতে সাহায্য করেছে, যা তাঁর ধারাবাহিক প্রাসঙ্গিকতা এবং জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করে।
ঐতিহ্যবাহী শারীরিক সংস্কৃতি/কুস্তি (আখড়া ঐতিহ্য) এর সাথে সংযোগ: হনুমানকে ভারতে কুস্তিগীর এবং মার্শাল আর্টিস্টদের পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসাবে ব্যাপকভাবে পূজা করা হয়, যা শক্তি এবং ক্ষমতার প্রতীক। বাংলায় ‘আখড়া’ (কুস্তি) সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল, যেখানে অম্বিকাচরণ গুহ এবং গোবর গুহের মতো কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলায় হনুমান পূজা কেবল আধ্যাত্মিক ছিল না, বরং একটি সামাজিক কার্যকারিতাও পূরণ করত, বিশেষ করে শারীরিক সংস্কৃতি এবং মার্শাল আর্টের ক্ষেত্রে, যা ধর্মীয় ভক্তিকে শারীরিক শৃঙ্খলা এবং শক্তির সাথে সংযুক্ত করে। এই সংযোগ হনুমানকে শারীরিক প্রশিক্ষণের এবং এমনকি ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার একটি ঐশ্বরিক পৃষ্ঠপোষক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ভক্তির এই ব্যবহারিক প্রয়োগ হনুমানকে জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশের কাছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক করে তোলে, যা তাঁর পূজা সামাজিক কাঠামোতে আরও গভীরভাবে প্রোথিত করে।
৩.৩. প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণ
সীমিত প্রাথমিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ: পণ্ডিতদের মতে, ২য় সহস্রাব্দ খ্রিস্টাব্দের আগে গ্রন্থ এবং বেশিরভাগ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে হনুমানের ভক্তিমূলক উপাসনার সরাসরি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মূলত অনুপস্থিত। হনুমানের চিত্র এবং শিলালিপির যাচাইযোগ্য প্রমাণ প্রথম ১০ম শতাব্দীতে মধ্য ও উত্তর ভারতে পাওয়া যায়। বাংলায় হনুমানের নির্দিষ্ট প্রাথমিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাব তাঁর অনুপস্থিতি বোঝায় না, বরং ইঙ্গিত দেয় যে তাঁর পূজা সম্ভবত আরও অনানুষ্ঠানিক, স্থানীয় বা বৃহত্তর বৈষ্ণব বা লোক অনুশীলনের মধ্যে একীভূত ছিল, যা পরবর্তী সময়কাল পর্যন্ত স্বতন্ত্র মূর্তি বা নিবেদিত মন্দির কাঠামো তৈরি করেনি। প্রথম পূজার জন্য নির্দিষ্ট অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে, প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যের এই সীমাবদ্ধতা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা।
পরবর্তী আইকনোগ্রাফি এবং মন্দির নির্মাণ: পশ্চিমবাংলায় হনুমানের পাথরের খোদাই পাওয়া যায়, এবং আধুনিক বৃহৎ মূর্তি (যেমন কালিম্পং, ২০২১) অব্যাহত ভক্তির ইঙ্গিত দেয়। তবে, এগুলি “প্রথম” পূজার প্রমাণ দেয় না।
বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম (প্রত্নতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট): গুপ্ত যুগে (খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী) বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রসারিত হতে শুরু করে এবং পাল যুগে বিষ্ণু মূর্তির আবিষ্কার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে এটি একটি শক্তিশালী ভিত্তি লাভ করে। এটি বিষ্ণু-সম্পর্কিত পূজার উপস্থিতির একটি সাধারণ প্রেক্ষাপট প্রদান করে, যা পরোক্ষভাবে প্রাথমিক রাম-হনুমান ভক্তিকে সমর্থন করতে পারে।
সারণী ১: বাংলায় হনুমান উপাসনার উপর মূল ঐতিহাসিক সময়কাল এবং প্রভাব
| সময়কাল/যুগ | মূল বিকাশ/প্রভাব (ভারতব্যাপী) | বাংলায় হনুমান উপাসনার উপর নির্দিষ্ট প্রভাব | প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র |
| বৈদিক যুগ (১৫০০-১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) | ঐশ্বরিক বানরের প্রাচীনতম উল্লেখ (প্রোটো-হনুমান) | প্রোটো-হনুমান ভক্তির অস্তিত্বের সম্ভাবনা, তবে সরাসরি হনুমান উপাসনার সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। | |
| ২য় সহস্রাব্দ খ্রিস্টাব্দ | ভক্তি ঐতিহ্যের উত্থান; রামায়ণ রচনার ১০০০ বছর পর হনুমানের ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব বৃদ্ধি; ইসলামিক শাসনের পর প্রতিরোধের প্রতীক। | ভক্তিমূলক রূপের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি; হনুমান উপাসনার ভিত্তি স্থাপন। | |
| ১৪শ-১৫শ শতাব্দী | – | কৃত্তিবাসী রামায়ণ দ্বারা হনুমান ও রামের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি; চরিত্রগুলির বাঙালি সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে পুনর্সৃষ্টি; হনুমানের গৃহস্থালী দেবতা হিসাবে পরিচিতি। | |
| ১৬শ শতাব্দী | তুলসীদাসের রামচরিতমানস ও হনুমান চালিশা রচনা। | হনুমান চালিশার ব্যাপক গ্রহণ ও প্রচলন; হনুমান ভক্তির গভীরতা বৃদ্ধি। | |
| ১৭শ শতাব্দী onwards | – | কালী দেবীর দ্বারপাল হিসাবে হনুমানের সমন্বিত রূপ; বাঙালি শাক্ত ঐতিহ্যে হনুমানের একীভূতকরণ। | |
| ১৮শ-১৯শ শতাব্দী | – | কুস্তি (আখড়া) সংস্কৃতির সাথে হনুমানের সম্পর্ক; শারীরিক শক্তি ও শৃঙ্খলার পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসাবে স্বীকৃতি; নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ কর্তৃক বড় মঙ্গল উৎসবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং বাংলায় এর গ্রহণ। |
৪. পশ্চিমবাংলার উল্লেখযোগ্য ও প্রাচীন হনুমান মন্দির
পশ্চিমবাংলায় “প্রথম” হনুমান পূজা কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না হলেও, বেশ কিছু প্রাচীন এবং উল্লেখযোগ্য হনুমান মন্দির রয়েছে যা এই অঞ্চলে হনুমান উপাসনার দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। এই মন্দিরগুলি, যদিও অগত্যা “প্রথম” নয়, তবে এগুলি এই পূজার প্রাচীনতম নথিভুক্ত বা ঐতিহ্যগতভাবে স্বীকৃত কেন্দ্রগুলিকে প্রতিনিধিত্ব করে।
সারণী ২: পশ্চিমবাংলার উল্লেখযোগ্য হনুমান মন্দির এবং তাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
| মন্দিরের নাম | অবস্থান | আনুমানিক বয়স/প্রতিষ্ঠাকাল | মূল বৈশিষ্ট্য/তাৎপর্য | প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র |
| রাজা কাটরা হনুমান মন্দির | কলকাতা (বড়বাজার) | প্রায় ৩৫০ বছর পুরোনো (১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি) | কলকাতার অন্যতম প্রাচীন হনুমান মন্দির; দক্ষিণমুখী পঞ্চমুখী হনুমানজি; মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য ভক্তদের ভিড়, বিশেষ করে মঙ্গল ও শনিবার। অবাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা। | |
| কালিম্পং হনুমান মন্দির | কালিম্পং | শতাব্দী প্রাচীন কাঠামোর প্রতিরূপ | শান্ত পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত শ্রদ্ধেয় মন্দির; ভক্তি, শক্তি ও ঐশ্বরিক সুরক্ষার প্রতীক; শতাব্দী ধরে পূজা ও সাংস্কৃতিক সমাবেশের কেন্দ্র। | |
| মাদরাল হনুমান মন্দির | কাঁকিনাড়া | অত্যন্ত প্রাচীন (ভক্তদের বিশ্বাস) | হনুমানজির বিরল “শায়িত” বা “বিশ্রামরত” মূর্তি; ভক্তদের বিশ্বাস যে হনুমানজি এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। | |
| দমদম হনুমান মন্দির | কলকাতা (দমদম) | প্রায় ১৫০ বছর পুরোনো | প্রতিদিন হনুমানজির আরাধনা; মঙ্গল-শনিবার এবং হনুমান জয়ন্তীতে বিশেষ পুজোপাঠ। | |
| বাল হনুমান মন্দির | কলকাতা (লেকটাউন) | – | হনুমান জয়ন্তী ছাড়াও মঙ্গল ও শনিবার জাঁকজমকের সঙ্গে পূজা; সুন্দরকাণ্ড পাঠ। | |
| ব্যারাকপুর হনুমান মন্দির | ব্যারাকপুর | – | সারা বছর ভক্তদের ভিড়; নিত্যযাত্রীরা যাতায়াতের পথে স্মরণ করেন। | |
| পাকুরিয়া সালাসার ধাম | পাকুরিয়া | – | পশ্চিমবাংলার একটি বিখ্যাত হনুমান মন্দির। |
রাজা কাটরা হনুমান মন্দির, কলকাতা: কলকাতার বড়বাজার এলাকায় অবস্থিত রাজা কাটরা হনুমান মন্দিরকে কলকাতার অন্যতম প্রাচীন হনুমান মন্দির হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যার বয়স প্রায় ৩৫০ বছর। এর অর্থ এটি প্রায় ১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই মন্দিরে দক্ষিণমুখী পঞ্চমুখী হনুমানজি রয়েছেন। হনুমানের পঞ্চমুখী রূপটি তাঁর বাধা অতিক্রম করার এবং সিদ্ধি (আধ্যাত্মিক ক্ষমতা) প্রদানের ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি একটি প্রধান তীর্থস্থান, বিশেষ করে হনুমান জয়ন্তী, মঙ্গল ও শনিবার ভক্তদের ভিড়ে পরিপূর্ণ থাকে।
রাজা কাটরা মন্দিরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ হনুমান মন্দির একটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র যেমন বড়বাজারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইঙ্গিত দেয় যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের, যারা প্রায়শই হনুমানের প্রতি গভীর ভক্তি রাখেন, তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ছিল। এই সম্প্রদায়গুলি শহুরে কেন্দ্রগুলিতে ধর্মীয় স্থান প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা করত। এটি বাংলার ধর্মীয় ল্যান্ডস্কেপে অর্থনৈতিক শক্তি এবং ভক্তির interplay-এর একটি উদাহরণ।
কালিম্পং হনুমান মন্দির: কালিম্পং-এর হনুমান মন্দিরকে “শতাব্দী প্রাচীন কাঠামোর প্রতিরূপ” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে এই স্থানে হনুমান মন্দিরের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যদিও বর্তমান ভবনটি মূল নয়। কালিম্পংয়ের শান্ত পাহাড়ে অবস্থিত এটি একটি “শ্রদ্ধেয় মন্দির”, যা ভক্তি, শক্তি এবং ঐশ্বরিক সুরক্ষার প্রতীক, যা সবুজে ঘেরা পরিবেশে অবস্থিত। মন্দিরটি শতাব্দী ধরে পূজা, উৎসব এবং সাংস্কৃতিক সমাবেশের একটি সম্প্রদায় কেন্দ্র হিসাবে কাজ করেছে, সংস্কার সত্ত্বেও এর পবিত্র ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়েছে। কালিম্পং-এ একটি শতাব্দী প্রাচীন কাঠামোর স্থানে একটি “প্রতিরূপ” মন্দিরের অস্তিত্ব পশ্চিমবাংলার নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে হনুমান পূজার একটি শক্তিশালী এবং ধারাবাহিক ঐতিহ্যকে নির্দেশ করে, এমনকি যদি মূল কাঠামোটি হারিয়েও যায়। এটি ইঙ্গিত করে যে কিছু পূজা দীর্ঘকাল ধরে টিকে ছিল, সম্ভবত কম শহুরে বা আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
মাদরাল হনুমান মন্দির, কাঁকিনাড়া: এই মন্দিরে হনুমানের একটি বিরল “শায়িত” বা “বিশ্রামরত” মূর্তি রয়েছে, যা ভারতে অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এই অনন্য মূর্তিটি একটি স্বতন্ত্র স্থানীয় ঐতিহ্য বা ব্যাখ্যাকে নির্দেশ করে। ভক্তরা এই মন্দিরটিকে “অত্যন্ত প্রাচীন” বলে মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন যে হনুমান এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। মাদরাল হনুমান মন্দিরের বিরল শায়িত মূর্তি, হনুমানের সেখানে বিশ্রাম নেওয়ার স্থানীয় কিংবদন্তির সাথে মিলিত হয়ে, বাংলার মধ্যে অনন্য মূর্তিগত রূপ এবং স্থানীয় পৌরাণিক আখ্যানগুলির বিকাশকে নির্দেশ করে, যা বৃহত্তর হনুমান উপাসনাকে সমৃদ্ধ করে। এটি প্রমাণ করে যে স্থানীয় বিশ্বাস এবং লোককথা কীভাবে একটি দেবত্বের উপাসনার রূপকে প্রভাবিত করতে পারে।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মন্দির: কলকাতার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ হনুমান মন্দিরগুলির মধ্যে দমদম হনুমান মন্দির প্রায় ১৫০ বছর পুরোনো। এটি প্রতিদিন পূজা এবং মঙ্গল-শনিবার ও হনুমান জয়ন্তীতে বিশেষ পুজোপাঠের জন্য পরিচিত। লেকটাউনে অবস্থিত বাল হনুমান মন্দির হনুমান জয়ন্তী ছাড়াও মঙ্গল ও শনিবার জাঁকজমকের সঙ্গে পূজা এবং সুন্দরকাণ্ড পাঠের জন্য বিখ্যাত। ব্যারাকপুর হনুমান মন্দির শিয়ালদা মেইন লাইনের ব্যারাকপুর স্টেশনেই অবস্থিত এবং সারা বছর ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে, যার মধ্যে নিত্যযাত্রীরাও অন্তর্ভুক্ত। পাকুরিয়া সালাসার ধামও পশ্চিমবাংলার একটি বিখ্যাত হনুমান মন্দির হিসাবে তালিকাভুক্ত। এই মন্দিরগুলি সম্মিলিতভাবে পশ্চিমবাংলায় হনুমান উপাসনার ব্যাপকতা এবং গভীরতা প্রদর্শন করে।
৫. সমসাময়িক অনুশীলন ও উৎসব
পশ্চিমবাংলায় হনুমান উপাসনা কেবল প্রাচীন মন্দিরগুলিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিভিন্ন উৎসব এবং সমসাময়িক অনুশীলনের মাধ্যমেও জীবন্ত রয়েছে।
৫.১. হনুমান জয়ন্তীর ব্যাপক উদযাপন
ভগবান হনুমানের জন্মবার্ষিকী উদযাপনকারী হনুমান জয়ন্তী ভারত জুড়ে, পশ্চিমবাংলা সহ, একটি প্রধান হিন্দু উৎসব হিসাবে পালিত হয়। এটি সাধারণত চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে (মার্চ/এপ্রিল) পড়ে। এই দিনে ভক্তরা মন্দির পরিদর্শন করেন, প্রার্থনা করেন, আরতি করেন, ভজন গান এবং হনুমান চালিশা ও সুন্দরকাণ্ড পাঠ করেন। এই উৎসবটি হনুমানের প্রতি ভক্তি এবং তাঁর গুণাবলী, যেমন শক্তি, ভক্তি এবং নম্রতার প্রতিচ্ছবি।
৫.২. বড় মঙ্গল উৎসব
বড় মঙ্গল, যা বুধওয়া মঙ্গল নামেও পরিচিত, এটি ভগবান হনুমানের প্রতি নিবেদিত একটি উৎসব, যা জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারগুলিতে পালিত হয়। এর জনপ্রিয়তা ১৯শ শতাব্দীতে অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে দায়ী করা হয়, যা তাঁর রানীর একটি মানত থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। নবাবের রানী একটি সন্তানের জন্য হনুমান মন্দিরে প্রার্থনা করেছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছা পূরণ হলে হনুমানের সম্মানে একটি উৎসব আয়োজনের মানত করেছিলেন। সেই থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
যদিও এটি বাংলার বাইরে উদ্ভূত হয়েছিল, পশ্চিমবাংলায় এর উদযাপন সর্বভারতীয় ভক্তিমূলক অনুশীলনের গ্রহণকে নির্দেশ করে। বড় মঙ্গলের মতো উৎসবগুলির গ্রহণ, যা অযোধ্যার একজন মুসলিম নবাবের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, বাঙালি হিন্দু অনুশীলনে ঐতিহাসিক আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সমন্বয়বাদকে প্রদর্শন করে যা ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে রূপ দিয়েছে। এটি দেখায় যে কীভাবে ধর্মীয় অনুশীলনগুলি আঞ্চলিক এবং এমনকি ধর্মীয় সীমানা অতিক্রম করতে পারে, যা জনপ্রিয় ভক্তিকে বিভিন্ন উৎস থেকে অনুশীলনগুলি শোষণ ও গ্রহণ করতে সক্ষম করে, যার ফলে হনুমান উপাসনা বৃহত্তর বাঙালি ধর্মীয় ক্যালেন্ডারে আরও একীভূত হয়।
Hanumanji : রহস্যময় পঞ্চমুখী হনুমান: এক অলৌকিক রূপের মহাজাগতিক শক্তি
৬. উপসংহার: একটি জীবন্ত ঐতিহ্য
পশ্চিমবাংলায় বজরংবলী পূজার “প্রথম” স্থান বা তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা ঐতিহাসিক প্রমাণাদির অভাবে সম্ভব নয়। তবে, প্রাপ্ত তথ্যগুলি ইঙ্গিত দেয় যে হনুমান উপাসনার একটি উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা এবং প্রতিষ্ঠা মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে এটি বিকশিত হয়েছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ এই জনপ্রিয়তার প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। এই মহাকাব্যটি হনুমানকে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর চরিত্রকে সহজলভ্য এবং প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এর পাশাপাশি, ভক্তি আন্দোলন এবং হনুমানের রামের প্রতি আদর্শ ভক্তের ভূমিকা তাঁর উপাসনার প্রসারে সহায়ক হয়েছে।
হনুমানের বাঙালি সংস্কৃতিতে একীভূতকরণ তাঁর অনন্য সমন্বিত সম্পর্কগুলির দ্বারা চিহ্নিত। কালী দেবীর দ্বারপাল হিসাবে তাঁর ভূমিকা এবং স্থানীয় শাক্ত ঐতিহ্যের সাথে তাঁর সংযুক্তি বাংলার ধর্মীয় অনুশীলনের অভিযোজনযোগ্য প্রকৃতিকে প্রদর্শন করে। একইভাবে, শারীরিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে কুস্তি, এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পর্ক তাঁর উপাসনাকে কেবল আধ্যাত্মিক স্তরেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং এটিকে সামাজিক এবং শারীরিক শৃঙ্খলার সাথেও যুক্ত করেছে। বড় মঙ্গলের মতো সর্বভারতীয় উৎসবগুলির গ্রহণও বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্যের গতিশীলতাকে তুলে ধরে, যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্মীয় অনুশীলনগুলি স্থানীয় প্রেক্ষাপটে একীভূত হয়।



















