ব্যুরো নিউজ ১৩ অক্টোবর ২০২৫ : শনিবার রাতে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে ভয়াবহ সহিংস সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বিপুল সংখ্যক সেনা নিহত হওয়ার পর রবিবার পাকিস্তান আফগানিস্তানের সাথে তাদের প্রধান সীমান্ত ক্রসিংগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। তালেবান সরকার এই সংঘাতকে পাকিস্তানের ‘বারবার লঙ্ঘন’-এর বিরুদ্ধে ‘সংকল্পবদ্ধ জবাব’ বলে দাবি করেছে।
ভয়াবহ হতাহতের দাবি ও সীমান্ত বন্ধ
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেছেন, সংঘর্ষে ৫৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৩০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের টোলো নিউজের খবর অনুযায়ী, নয় জন তালিবান যোদ্ধাও প্রাণ হারিয়েছেন এবং ১৬ জন আহত হয়েছেন। হেলমান্দ প্রদেশের বাহরামচা এলাকায় আফগান বাহিনী তিনটি পাকিস্তানি নিরাপত্তা চৌকি দখল করেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।
জবাবে পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে তুরখাম (Torkham) এবং চমন (Chaman) সহ অন্যান্য ছোট সীমান্ত পথ (যেমন খারলাচি, আঙ্গুর আড্ডা, এবং গুলাম খান) বন্ধ করে দেয়।
তালিবানের পাল্টা আঘাতের কারণ
আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াকুব মুজাহিদ এই হামলাকে পাকিস্তানের ‘আঞ্চলিক এবং আকাশসীমার বারবার লঙ্ঘনের’ বিরুদ্ধে একটি ‘প্রতিশোধমূলক এবং সফল অভিযান’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, আফগান বাহিনী ডুরান্ড লাইন বরাবর উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে এবং পাকিস্তান যদি এমন পদক্ষেপের পুনরাবৃত্তি করে তবে আরও জোরালো জবাব দেওয়া হবে।
যদিও পাকিস্তান এই হামলার জন্য তালেবানকে দায়ী করে বলেছে যে, তালিবান বাহিনী আঙ্গুর আড্ডা সহ একাধিক পাকিস্তানি সীমান্ত পোস্টে গুলি চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (TTP)-কে পাকিস্তানে প্রবেশে সহায়তা করার চেষ্টা করছিল। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী মহসিন নকভি এই আফগান হামলাকে ‘অপ্ররোচিত’ বলে দাবি করেছেন।
ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা ও সৌদি আরবের ভূমিকা
দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তান অভিযোগ করে আসছে যে আফগান তালেবানরা টিটিপি (পাক তালেবান)-কে আশ্রয় দিচ্ছে, যারা পাকিস্তানে অসংখ্য মারাত্মক হামলা চালিয়েছে। টিটিপি-র আক্রমণে একাই ২০২৪ সালে ৬০০টিরও বেশি পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে বলে একটি মার্কিন গবেষণা দল জানিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আফগান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁদের ভূমিকে ‘সন্ত্রাসী উপাদান’-দের ব্যবহার করতে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন এবং যেকোনো উস্কানির ‘শক্তিশালী ও কার্যকর জবাব’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই উত্তেজনার মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্প্রতি স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তিটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই চুক্তি অনুসারে, এক দেশের উপর আক্রমণ উভয় দেশের উপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে। বিশ্লেষকদের মতে, রিয়াদ সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত না দিলেও, এই চুক্তি পাকিস্তানকে একটি কৌশলগত নিশ্চয়তা দিচ্ছে।
এদিকে, সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (MOFA) এক বিবৃতিতে উভয় পক্ষকে ‘সংযম বজায় রাখতে’ এবং সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে।
রাজনৈতিক আখ্যান ও ভবিষ্যৎ সংঘাতের ইঙ্গিত
সৌদির ওয়াহাবি দর্শন যে তালিবানের দেওবন্দি দর্শনের পরিপন্থী নয়, সেই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের পুরোনো প্রচেষ্টা ছিল সৌদির ওয়াহাবি ইসলাম দর্শনকে তালেবানের হাক্কানি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে ভারতীয় দেওবন্দ ইসলাম দর্শনের মধ্যে একটি বিভাজন সৃষ্টি করা। বর্তমান তালেবান সরকার ভারতীয় দেওবন্দ ইসলাম দর্শনের প্রতি সহানুভূতিশীল।
এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় তালিবান কর্তৃক একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানোর ছবি প্রকাশ পেয়েছে। মোটের উপর এই ঘটনাকে পাক-আফগান যুদ্ধের সূচনা বলেই মনে করা হচ্ছে। যেখানে পাকিস্তান চাইছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাগ্রাম বিমানঘাঁটির মাধ্যমে পুনরায় আফগানিস্তানে প্রবেশ করুক, কিন্তু আফঘান বিমান সুরক্ষার উন্নয়নের পরিকল্পনায় তালিবান তাদের বাগ্রাম বিমান ঘাঁটিটি ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করছে । তালেবান নিজেদের দেশে আর কোনো রকম যুদ্ধবাজ, সন্ত্রাসবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রবেশে নারাজ।