ব্যুরো নিউজ ১ আগস্ট : বিহারের পর এবার পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হতে চলেছে ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধন প্রক্রিয়া। সাধারণ নির্বাচনের আগে এই সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমেই ঠিক হবে কে ভোট দিতে পারবেন আর কে নন। স্বাভাবিকভাবেই এই দায়িত্বভার এসে পড়েছে বুথ লেভেল অফিসারদের (BLO) উপর। কিন্তু ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক মন্তব্যে ঘিরে রাজ্যের BLO মহলে ছড়িয়ে পড়েছে চরম ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা।
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী এক সরকারি অনুষ্ঠানে BLO-দের উদ্দেশে বলেন, “ভোটার তালিকার কাজটা ভাল করে করবেন। কারও নাম যেন ভুল করে বাদ না যায়।” এই বক্তব্যকে অনেক BLO এবং তাঁদের সংগঠন ‘ঠাণ্ডা হুমকি’ বলেই চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য মূলত চাপ তৈরি করার চেষ্টা, যা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ কার্যপদ্ধতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে।
BLO-দের প্রতিক্রিয়া: ‘‘আমরা শিরদাঁড়া বিক্রি করব না’’
ব্লক ও জেলা স্তরে কর্মরত BLO-রা একে একে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। পূর্ব বর্ধমানের এক BLO তথা শিক্ষক অনিতা সরকার বলেন, “এটা এক ধরনের প্ররোচনা। আমরা কমিশনের নির্দেশেই কাজ করব। কারও ঠিকানায় না থাকলে বা নাগরিক না হলে নাম তালিকায় থাকা উচিত নয়।”
আসানসোলের BLO চিরঞ্জিত ধীবর বলেন, “ভোটার তালিকায় এখনও অনেক মৃত বা ভুয়ো নাম রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যেন বলছেন, কোনও নাম বাদ না দিতে! আমরা কি তবে দায়িত্ব নিয়ে এসবই রেখে দেব?” তাঁর কথায় স্পষ্ট, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁরা কোনও রাজনৈতিক চাপ নিতে রাজি নন।
আরও কড়া সুরে কথা বলেছেন BLO সংগঠনের আহ্বায়ক অনিমেষ হালদার। তিনি জানিয়েছেন, “যতক্ষণ না আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে, আমরা দায়িত্ব পালন করব না। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য আমাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।” একইসঙ্গে শিক্ষক প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “আমরা নিয়ম মেনে কাজ করব, ভয় পাই না। মুখ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্য নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতায় হস্তক্ষেপের সামিল।”
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। BLO-রা অভিযোগ করছেন, ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো সংবেদনশীল কাজে তাঁদের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা না দিলে প্রকৃত তথ্য উঠে আসবে না। অনেকেই বলছেন, যদি এইভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়, তবে তালিকায় ভুয়ো নাম থাকবেই এবং প্রকৃত ভোটার বাদ পড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন কমিশনের উচিত দ্রুত BLO-দের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের মতামত শোনা এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। যাতে ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।
রাজনৈতিক চাপ কি আগে থেকেই?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য একটি “সিগন্যাল” — যাতে সংশোধনের আগেই BLO-দের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা যায়। মূলত কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্বের আবহে রাজ্যের শাসকদল নির্বাচন কমিশনের প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে চাইছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
BLO-দের অনেকে সরাসরি বলেছেন, “দায়িত্ব নেওয়ার আগেই রাজনৈতিক চাপ শুরু হয়েছে। তবে আমরা মাথা নত করব না। শিরদাঁড়া বিক্রি করব না।” এ ধরনের স্পষ্ট অবস্থান ভোটের নিরপেক্ষতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
আগামী দিনে কী ঘটতে পারে?
BLO-দের ধর্মঘট: যদি মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ে, তবে কর্মবিরতি বা প্রতিবাদ কর্মসূচি ডাকা হতে পারে।
কমিশনের হস্তক্ষেপ: নির্বাচন কমিশন যদি রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তবে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারে।
রাজনৈতিক উত্তাপ বৃদ্ধি: বিজেপি ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে। ফলে এই ইস্যু ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল।