Lord Krishna forsakes Yaduvansh

ব্যুরো নিউজ ০৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২৫ : “অন‍্যথা চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে । তেঽপি মামেব কৌন্তেয় যান্তি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ ॥” — শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৯.২৩

শ্রীকৃষ্ণের জীবনের অন্যতম একটি অদ্ভূত সত্য হলো, তাঁর নিজের জ্ঞাতিবর্গ, সেই প্রতাপশালী যাদবগণ যারা তাঁর দিব্য যত্নে জন্ম ও লালিত হয়েছিলেন, অবশেষে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে তাঁর থেকে আত্মিকভাবে দূরে চলে গেলেন এবং নিজেদেরকেই ধ্বংস করলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনকে বলা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, আজ অন্তরের স্বচ্ছতা এবং আধ্যাত্মিক শক্তির একটি শাশ্বত পথপ্রদর্শক। তবুও এর শ্লোকগুলির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু শক্তিশালী সত্য লুকিয়ে আছে: কোনো বন্ধনই স্থায়ী হয় না যখন তা ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, এমনকি ঈশ্বরের সঙ্গে পরিবারের বন্ধনও নয়।

এটি সেই বিস্মৃত শিক্ষা: প্রজ্ঞা ছাড়া আসক্তি পতনের কারণ হতে পারে, এমনকি আপনি যদি স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকেন।

১. কৃষ্ণ আনুগত্য চাননি, তিনি দর্শন প্রদান করেন 

শাসক বা গুরুরা যেখানে অন্ধ আনুগত্য দাবি করেন, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বারবার ভাবতে, প্রশ্ন করতে এবং স্বাধীনভাবে বেছে নিতে উৎসাহিত করেছেন। অষ্টাদশ অধ্যায়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন: “এই জ্ঞান আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করেছি… গভীরভাবে এটি নিয়ে চিন্তা করো, এবং তারপর তোমার যা ইচ্ছা তা করো।” শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর ভক্তদের সম্পর্ক জোর করে তৈরি হওয়া আনুগত্যের ওপর নয়, বরং সচেতন পছন্দের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। দুর্ভাগ্যবশত, যাদবরা তাঁর ঐশ্বরিক সান্নিধ্যে অহংকারী হয়ে উঠেছিল। যা আনুগত্য হিসাবে শুরু হয়েছিল, তা অধিকারবোধে পরিণত হয়েছিল।

গীতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আধ্যাত্মিক দৃষ্টি পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে শক্তিশালী হতে হবে। অর্জুনকে শেখানো হয়েছিল কীভাবে তাঁর আসক্তির ঊর্ধ্বে সত্যকে দেখতে হয়। যাদবরা তাদের অহংকারে অন্ধ হয়ে অন্তরের দিকে তাকায়নি। এ কারণেই শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যও তাদের রক্ষা করতে পারেনি।

সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ

২. ক্ষমতার প্রতি আসক্তি আধ্যাত্মিক সুরক্ষা বাতিল করে

গীতা বারবার নরকের তিনটি দ্বার সম্পর্কে সতর্ক করে: কাম, ক্রোধ এবং লোভ। যাদবরা ভুলে গিয়েছিল যে কৃষ্ণ তাদের রক্ষক ছিলেন, তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার উৎস নন। তারা তাঁর সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ক্ষমতা লাভ, আধিপত্য বিস্তার এবং অহংকারী জীবনযাপনের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।

শিক্ষাটি স্পষ্ট। শুধুমাত্র তখনই ঐশ্বরিক উপস্থিতি সুরক্ষা দেয়, যখন মন ধর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যখন অহংকার ও গর্ব নম্রতা ও শৃঙ্খলার স্থান নেয়, তখন স্বয়ং ঈশ্বরও তার পরিণতিকে আটকাতে পারেন না।

 

৩. রক্তের বন্ধনের চেয়ে ধর্ম উচ্চতর

জন্মের পর বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর শত্রুদের মোকাবিলা করা—এইসব অন্তহীন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ কখনো তাঁর ঐশ্বরিক তৃপ্তি হারাননি। গীতার অন্যতম একটি মৌলিক শিক্ষা হলো, ধর্ম বা ধার্মিক কর্তব্য পরিবারের প্রতি যেকোনো আসক্তির চেয়ে উচ্চতর।
অর্জুনের সংকট এসেছিল তাঁর নিজের আত্মীয়দের ক্ষতি করার ভয় থেকে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে মনে করিয়ে দেন, “তোমার কর্তব্য তোমার ধর্মের প্রতি, তোমার সম্পর্কের প্রতি নয়।” এই নীতিই ব্যাখ্যা করে শ্রীকৃষ্ণ যাদবদের ওপর পতিত অভিশাপকে থামাননি। তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন, কারণ এটি ছিল ধর্ম কর্তৃক বংশের অহংকারকে শুদ্ধ করার একটি উপায়।

পরিবার পবিত্র, কিন্তু যখন পরিবার ধর্মকে ভুলে যায়, তখন ধর্মকেই সমুন্নত রাখতে হয়।


৪. জন্ম মুক্তির নিশ্চয়তা নয়

গীতা জুড়ে শ্রীকৃষ্ণ বারবার বলেছেন যে, আধ্যাত্মিক সাফল্যের কোনো স্বয়ংক্রিয় দাবি কারও নেই। “যে যে পথেই আমার কাছে আসে, আমি তাদের গ্রহণ করি…” (গীতা ৪.১১)। শ্রীকৃষ্ণের নিজের বংশের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল। তারা তাঁর উপস্থিতিতে বাস করত, হাসত এবং রাজত্ব করত। তবুও তারা গর্ব ও অজ্ঞতার মাধ্যমে সেই আশীর্বাদ নষ্ট করেছে।

এটি একটি কঠিন সত্য প্রকাশ করে: আমরা যদি সেই সত্যকে অন্তরে ধারণ না করি, তাহলে মহানতার কাছাকাছি থাকা অর্থহীন। ঐতিহ্য, সামাজিক মর্যাদা বা জন্ম মুক্তি নিশ্চিত করে না।

 

৫. ঈশ্বরও স্বাধীন ইচ্ছা এবং কর্মকে সম্মান করেন

গীতা আমাদের শেখায় কীভাবে প্রতিদানে কিছু না চেয়ে অবাধে ভালোবাসতে হয়। সেখান থেকেই আসল শান্তি শুরু হয়।
শ্রীকৃষ্ণ যাদবদের আত্ম-বিনাশ থেকে রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেননি। কেন?
কারণ গীতা শিক্ষা দেয় যে কর্মের নিয়ম ব্যক্তিগত পছন্দের ঊর্ধ্বে। ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত মানুষের কর্মের ফলকে ঈশ্বর বাধা দেন না।

যাদবরা যখন ঋষিদের উপহাস করেছিল এবং মত্ত অহংকারে লিপ্ত হয়েছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণ পিছিয়ে এসেছিলেন। তারা তাদের কর্মের ফল ভোগ করেছিল। এটি বিনয়ের একটি গভীর শিক্ষা। ঈশ্বর আমাদের স্বাধীনতাকে সম্মান করেন, কিন্তু আমরা যা বেছে নিই, তা থেকে আমাদের রক্ষা করেন না।

 

৬. এই পৃথিবীর সবকিছুই নশ্বর

যাদব বংশের ধ্বংস কেবল নৈতিক পতনের গল্প নয়। এটি এই বিশ্বের পরিবর্তনশীল প্রকৃতির একটি শিক্ষাও বটে। গীতা ব্যাখ্যা করে যে, সব রূপ, এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী রাজবংশও অস্থায়ী। শ্রীকৃষ্ণের নিজের জীবনই দেখায় যে কোনো বন্ধন, কোনো সাম্রাজ্য, কোনো ক্ষমতা চিরন্তন নয়।

তিনি দেখিয়েছেন যে তিনি এই ক্ষণস্থায়ী বন্ধনগুলির ঊর্ধ্বে। আমাদেরও তাই হওয়া উচিত। যখন আমরা মানুষ, পদ বা পারিবারিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে আঁকড়ে থাকি, তখন আমরা আমাদের ভিতরের শাশ্বত আত্মাকে ভুলে যাই, যা কখনো মরে না।


Brahma ; সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সীমিত উপাসনা: এক বিস্ময়কর রহস্য !

৭. আসল পরিবার হলো আত্মা

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ‘বন্ধু’ এবং ‘প্রিয় ভক্ত’ বলে সম্বোধন করেছেন। রক্তের কারণে নয়, বরং অর্জুন শুনতে এবং রূপান্তরিত হতে ইচ্ছুক ছিলেন বলেই।
ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের আসল সম্পর্ক জন্ম থেকে আসে না, বরং নিজের মধ্যে আত্মাকে উপলব্ধি করার মাধ্যমে আসে। শুদ্ধ চেতনা, আত্মাই আমাদের আসল পরিবার।
শ্রীকৃষ্ণের পরিবার ভেঙে গিয়েছিল, কারণ তারা বাহ্যিক পরিচয়ের সঙ্গে আঁকড়ে ছিল কিন্তু আত্মাকে উপেক্ষা করেছিল। যখন আমরা আমাদের প্রকৃত প্রকৃতি ভুলে যাই, তখন আমাদের সব সম্পর্ক ভঙ্গুর হয়ে যায়।

 

যখন দূরত্ব বজায় রাখা ধর্ম 

মহাভারতের শেষ অধ্যায়গুলিতে, শ্রীকৃষ্ণ নীরবে তাঁর নিজের লোকদের থেকে দূরে সরে যান, যখন তারা একে অপরকে ধ্বংস করে। তিনি তাদের জোর করে পরিবর্তন করেননি। যা তার ধর্মকে অতিক্রম করেছে, তার সমাপ্তি তিনি মেনে নিয়েছেন।
আমাদেরও একইভাবে শিখতে হবে। কখনও কখনও, আমাদের এমন সম্পর্ক, গোষ্ঠী বা ধারণা থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত, যা আমাদের অজ্ঞতার দিকে টেনে নিয়ে যায়। অজ্ঞতার প্রতি অনুগত থাকা ধর্ম নয়।

গীতার লুকানো শিক্ষাটি নির্মমভাবে মানুষকে ত্যাগ করা নয়। এটি হলো স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে সত্যকে বেছে নেওয়ার, অন্ধ আনুগত্যের চেয়ে দৃষ্টিকে বেছে নেওয়ার এবং আসক্তির চেয়ে ধর্মকে বেছে নেওয়ার সাহস থাকা। এমনকি এর মূল্য যদি আমাদের নিকটতম ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়াও হয়।

যেখানে ধর্ম জীবিত, সেখানেই পরিবার টিকে থাকে। যখন ধর্ম পতন হয় , পরিবার ভেঙে যায়। এই কথাটি যেন আমরা কখনো ভুলে না যাই।

॥ ওঁ তৎসৎ ॥

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর