akal bodhan bengal

ব্যুরো নিউজ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : বাংলায় দুর্গা পূজা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন। সারা বছর বাঙালিরা এই কয়েকটি দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু একটা কথা প্রায়শই প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, “এ তো আসল দুর্গা পূজা নয়, এ হল অকাল বোধন।”

‘অকাল বোধন’ শব্দের অর্থই হল ‘অসময়ে দেবীকে আহ্বান’। পুরাণ মতে, দেবী দুর্গার আরাধনার প্রকৃত সময় হল বসন্তকাল, যা ‘বাসন্তী পূজা’ নামে পরিচিত। তাহলে কেন আমরা শরৎকালে এই বিশাল উৎসব পালন করি? এর উত্তর লুকিয়ে আছে রামায়ণের এক কিংবদন্তিতে।

 

অকাল বোধন: কেন এই অসময়ে পূজা?

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, দেব-দেবীরা সাধারণত বর্ষাকালের চার মাস নিদ্রায় থাকেন। কিন্তু প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে শরৎকালে দেবী দুর্গাকে আহ্বান করার এই প্রথাকেই বলা হয় অকাল বোধন। এর পেছনের মূল কারণটি হল শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক দেবী দুর্গার পূজা।
যখন রাবণ সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়, তখন সীতাকে উদ্ধার করতে শ্রীরামচন্দ্র যুদ্ধ শুরু করার আগে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ চেয়েছিলেন। রাবণকে দেবী দুর্গা এই বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর অনুমতি ছাড়া রাবণকে কেউ বধ করতে পারবে না। তাই যুদ্ধ শুরুর আগে রামচন্দ্র দেবীর পূজা করার সিদ্ধান্ত নেন। দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ১০৮টি নীল কমল (নীল পদ্ম) প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি ১০৭টি নীল কমল জোগাড় করতে পারলেন। তখন তিনি দেবীকে ১০৮তম পদ্ম হিসেবে নিজের চোখ অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তাঁর চোখ নীল কমলের মতোই সুন্দর ছিল। যখন রামচন্দ্র তির দিয়ে নিজের চোখ উপড়ে ফেলতে গেলেন, তখন দেবী দুর্গা আবির্ভূত হয়ে তাঁকে বাধা দিলেন। রামের এই গভীর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে দেবী তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। এই আশীর্বাদের জোরেই রাম রাবণকে বধ করতে সক্ষম হন।

বিশ্বাস করা হয়, রামচন্দ্র আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবীকে অসময়ে আহ্বান করেছিলেন এবং দশম দিনে রাবণকে বধ করেছিলেন। এই দিনটি ‘অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির জয়’ হিসেবে পালিত হয়। বাঙালিরা এই দিনটিকে বিজয়া দশমী বলে, আর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এটি দশেরা নামে পরিচিত।

Durga Puja : দুর্গার রহস্যময় চৌষট্টি যোগিনী কেন আজও প্রাসঙ্গিক ?

বাসন্তী পূজা: দেবী পূজার প্রকৃত সময়

শাস্ত্র মতে, দেবী দুর্গার পূজা করার প্রকৃত সময় হল বসন্তকাল, যা সাধারণত চৈত্র মাসে (মার্চ-এপ্রিল) হয়ে থাকে। এই পূজাটি বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। যদিও এই পূজা এখনও অনেক জায়গায় পালিত হয়, তবে এটি শরৎকালের শারদীয়া নবরাত্রির মতো ততটা জনপ্রিয় নয়। এটিই ছিল দুর্গাপূজার মূল সময়, কিন্তু রামের অকাল বোধনের পর থেকে শারদীয়া দুর্গাপূজাই প্রধান হয়ে উঠেছে।

 

পূজার সূচনা: কল্পারম্ভ ও নবপত্রিকা

শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা হয় কল্পারম্ভ নামক একটি আচার দিয়ে, যা নবরাত্রির প্রথম দিনে ঘটস্থাপনার সমতুল্য। এই দিনে দেবীকে বেল গাছের নিচে বা একটি কলসে আহ্বান করা হয়। দেবীকে আহ্বান করার এই প্রক্রিয়াকে আমন্ত্রণ এবং তাঁর আত্মাকে বেল গাছে স্থাপন করাকে অধিবাস বলা হয়। এই দিনটিকেও অকাল বোধন বলা হয়, কারণ এটিই সেই দিন যখন দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। কল্পারম্ভের পরের দিন নবপত্রিকা পূজা বা কলাবউ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

Durga Puja : নবদুর্গা , মা দুর্গার নয় রুপের তাৎপর্য !

ঐতিহ্যের বিবর্তন ও লোকবিশ্বাস

লোককথা অনুযায়ী, দেবী দুর্গা তাঁর চার সন্তান গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে নিয়ে প্রতি বছর পিতৃগৃহে অর্থাৎ পৃথিবীতে আসেন। মহালয়ার পুণ্য তিথিতে পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়, যা পনেরো দিন স্থায়ী হয়। এই দিন থেকেই দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা শোনা যায়।
দুর্গাপূজার এই উৎসব মধ্যযুগে শুরু হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে, যখন জমিদার এবং ধনী অভিজাতরা এটি পালন করা শুরু করেন। এই সময় তাঁদের বাড়ির দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হত এবং সবাই একসাথে উৎসবে অংশ নিত। এভাবে দুর্গাপূজা সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে এই উৎসব বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজার রূপ নেয়, যা সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি বাঙালি সংস্কৃতি এবং লোককাহিনীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রামের অকাল বোধন থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব এখন এক মহা সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, যা বাঙালির জীবনে আনন্দ, ঐক‍্য এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসে।

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর