16 shringar gauri

ব্যুরো নিউজ ৩১ অক্টোবর ২০২৫ : বহু শতাব্দী, সংস্কৃতি এবং প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্য কেবল ত্বককেন্দ্রিক বিষয় হইয়া থাকে নাই। ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্যে ‘ষোড়শ শৃঙ্গার’ বা ষোলোটি প্রসাধনের ধারণাটি ইহার এক চমৎকার উদাহরণ, যেখানে বাহ্যিক অলঙ্করণ এক গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করে।

ষোড়শ শৃঙ্গার কেন এত শক্তিশালী বলিয়া বিবেচিত হয় এবং কেনই বা ইহা আজও আচার-অনুষ্ঠান, বিবাহ এবং দৈনন্দিন জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া আছে? আসুন, সেই প্রাচীন উৎস, প্রতীকী অর্থ এবং আধুনিক মহিলাদের মধ্যে ইহার পুনরুজ্জীবনের কারণগুলি আলোচনা করা যাক।

 

১. ষোড়শ শৃঙ্গার কী এবং কেন ‘ষোলো’ সংখ্যাটি পবিত্র?

‘শৃঙ্গার’ শব্দের অর্থ হইল ‘ভূষণ’ বা ‘সৌন্দর্যায়ন’, কিন্তু ‘ষোড়শ শৃঙ্গার’ একটি অধিকতর গভীর ধারণা। ইহা সেই ষোলোটি চিরাচরিত পদ্ধতির সমষ্টি, যাহার মাধ্যমে এক নারী তাঁহার রূপ-লাবণ্যকে বর্ধিত করেন — সিঁথিতে সিঁদুর হইতে শুরু করিয়া চুড়ি, বিন্দি, কাজল এবং নূপুর পরিধান পর্যন্ত।

প্রচলিত বিশ্বাস মতে, এই ‘ষোলো’ সংখ্যাটি বিশেষ পবিত্র। ইহা চন্দ্রের ষোলোটি কলা (phases/aspects) এবং জীবনের পূর্ণতার প্রতীক। হিন্দু ধর্মমতে, পূর্ণিমাতে চন্দ্র ষোলো কলাতে পূর্ণ হয়, আর এই ষোলোটি সজ্জা নারীর মধ্যে সেই পূর্ণতার ঐশ্বরিক শক্তি এবং জীবনদাত্রী রূপটিকে জাগ্রত করে। ষোড়শ শৃঙ্গার কেবল সৌন্দর্য নহে—ইহা জীবনশক্তি, নারীত্ব এবং ঐশ্বরিক শক্তির এক উদযাপন।

Jagatdhatri Puja : নবাবের কারাগারে মহারাজের অশ্রু থেকে বঙ্গে মা জগদ্ধাত্রীর আবির্ভাব – অত্যাচারের মাঝে প্রতিরোধের ইতিহাস !

২. প্রাচীন আধ্যাত্মিক ভিত্তি: দেবী ও শক্তির আরাধনা

ষোড়শ শৃঙ্গারের উৎস বৈদিক এবং পৌরাণিক শাস্ত্রে, বিশেষত দেবী-উপাসনার প্রসঙ্গে পাওয়া যায়। প্রেম, ভক্তি ও শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী পার্বতীকে প্রায়শই ষোলোটি শৃঙ্গারে অলঙ্কৃতা অবস্থায় বর্ণনা করা হয়, যখন তিনি মহাদেব শিবকে বরণ করিয়া লইতেছেন।

প্রাচীনকালে বিশ্বাস করা হইত যে শৃঙ্গার:

  • নারীর আভ্যন্তরীণ পবিত্র জ্যোতি বা ‘আওরা’কে সুরক্ষা প্রদান করে।
  • গর্ভধারণ ও জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে।
  • পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
  • নারীর মধ্যে বিদ্যমান দেবীসত্তাকে সম্মান জানায়।

এই সজ্জা কেবল সুন্দর দেখাইবার জন্য ছিল না—ইহা ছিল নিজেকে মহাজাগতিক শক্তির সহিত সংযুক্ত করা এবং ইতিবাচকতাকে বরণ করিয়া লওয়ার একটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া।

 

৩. অলঙ্কার সমূহের নিগূঢ় আধ্যাত্মিক অর্থ

ষোড়শ শৃঙ্গারের প্রতিটি উপাদানই শিল্প, বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ। ইহার কয়েকটি উপাদানের প্রতীকী অর্থ নিচে দেওয়া হইল:

ক্রমশৃঙ্গারের উপাদান (Original)প্রতীকী অর্থ ও তাৎপর্য (Symbolic Meaning)
১.স্নগ্ধ কেশ (Hair Adornment)চুল বাঁধা বা সজ্জিত করা শৃঙ্খলা, মঙ্গল এবং সমৃদ্ধির প্রতীক।
২.সীমন্ত সিঁদুর (Sindoor)চুলের সিঁথিতে প্রয়োগ করা হয়, দাম্পত্য অবস্থা ও স্বামীর দীর্ঘায়ু নির্দেশ করে। শক্তির প্রতীক
৩.বিন্দি (Bindi)কপালে পরা হয়, তৃতীয় নয়ন বা আজ্ঞা চক্রকে প্রতিনিধিত্ব করে, আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা জাগ্রত করে।
৪.মাঙ্গটিকা (Maang Tikka)কপালে পরা হয়, আজ্ঞা চক্রকে শক্তিশালী করে, অন্তর্দৃষ্টি ও একাগ্রতার সহিত যুক্ত।
৫.কাজল/সুরমা (Kajal/Kohl)চোখে দেওয়া হয়, কুনজর হইতে সুরক্ষা এবং চোখ শীতল রাখে।
৬.নথ (Nose Ring)প্রজনন স্বাস্থ্যের সহিত সংযুক্ত এবং সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবে দেখা হয়।
৭.কর্ণফুল/দুল (Earrings)কানের ছিদ্র বা অ্যাকুপ্রেশার পয়েন্টকে উদ্দীপিত করে, যাহা সুস্বাস্থ্যের সহিত সম্পর্কিত।
৮.হার (Necklace)হৃদচক্রের কাছে অবস্থান করে, আবেগজনিত সংযোগ ও ভালোবাসাকে শক্তিশালী করে।
৯.আঙটি (Rings)শাশ্বত বন্ধনের প্রতীক এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুর প্রান্তের সহিত যুক্ত আঙুল অলঙ্কৃত করে।
১০.বালা/চুড়ি (Bangles)মণিবন্ধের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চালিত করে, স্বাস্থ্য ও ইতিবাচকতা বৃদ্ধি করে।
১১.বাজুবন্ধ (Armlets/Armbands)উপরের বাহুতে পরা হয়, শারীরিক শক্তি ও কমনীয়তা বৃদ্ধি করে।
১২.কটিবন্ধ (Kamarbandh/Waistband)অঙ্গস্থিতিকে সহায়তা করে এবং জঠর বা জরায়ুকে সুরক্ষিত রাখে।
১৩.পায়ের আঙটির/চুটকি (Toe Rings)বিবাহিত মহিলারা পরেন, প্রজনন স্বাস্থ্যের সহিত জড়িত স্নায়ুকে উদ্দীপিত করে।
১৪.নূপুর (Anklets)নিম্নাঙ্গের স্নায়ুকে উদ্দীপিত করে এবং দেহের শক্তিকে ভারসাম্যযুক্ত রাখে।
১৫.সুগন্ধী/ইত্র (Perfume/Itar)মেজাজ উন্নত করে এবং মনকে প্রফুল্ল ও উন্নত ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে।
১৬.পোশাক (Clothing – Sari/Lehenga)মর্যাদা, সৌন্দর্য এবং দেহের শক্তিক্ষেত্রকে আবৃত করার প্রতীক।

এই প্রতিটি সজ্জাই নারীকে কেবল রূপবতী নয়, বরং শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী ও ভারসাম্যযুক্ত করিয়া তোলে।

Jagatdhatri Puja : চন্দননগরের স্বাদ কলকাতায়: বনেদি বাড়ির ঐতিহ্য ও ট্যাংরার জমকালো বারোয়ারি পুজো


৪. মর্যাদার প্রতীক: আধুনিক জীবনে প্রাসঙ্গিকতা

আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে, শৃঙ্গার প্রায়শই ‘সেকেলে’ বা ‘পুরুষতান্ত্রিক’ বলিয়া খারিজ হইতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করিলে দেখা যায় যে, এই প্রথা নারীকে বঞ্চনা করিবার জন্য কখনও ছিল না। বরং, ইহা দৈনন্দিন জীবনে দেবীসত্তার শক্তিকে সম্মান জানাইবার এক শক্তিশালী উপায়।

নারী যখন তাঁহার সৌন্দর্য, জীবনীশক্তি এবং লাবণ্যকে সশ্রদ্ধচিত্তে উদযাপন করেন, তখন তিনি শক্তির (Shakti) প্রকাশ রূপেই নিজের স্থান অধিকার করেন। রাজমাতা এবং দেবীরা শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি রূপেই চিত্রিত হইতেন।

আজকের দিনে বিবাহ ও উৎসবে ষোড়শ শৃঙ্গারের পুনরুত্থান কেবল সামাজিক রীতির অনুসরণ নয়, ইহা ব্যক্তিগত গৌরব ও আত্ম-প্রেমের উদযাপন। এই প্রথা নারীর অন্তর এবং বাহিরের শক্তিকে সমন্বিত করিয়া তাঁহাকে দিব্য জীবনযাপনে উৎসাহিত করে।

 

শেষ কথা: আত্ম-মর্যাদার শাশ্বত আহ্বান

যুগের পরিবর্তন হইলেও ষোড়শ শৃঙ্গারের মতো ঐতিহ্যগুলি আজও বিদ্যমান, কারণ তাহারা আমাদের অন্তরের শাশ্বত অনুভূতির সহিত সংযুক্ত। বাহ্যিক সৌন্দর্যকে সম্মান জানাইতে গিয়া, তাহারা আমাদের অন্তরের দেবত্বকেও যেন সম্মান জানাইতে স্মরণ করাইয়া দেয়।

অতএব, যখন আপনি কাজল পরেন বা একটি বালা পরিধান করেন, স্মরণ রাখিবেন—আপনি জীবনের, আত্মার এবং নারীত্বের এক প্রাচীন মহোৎসবে অংশগ্রহণ করিতেছেন। আর এই শক্তি, সত্যই, কখনও ম্লান হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর