ব্যুরো নিউজ ৩০ অক্টোবর ২০২৫ : মা জগদ্ধাত্রী দেবী দুর্গারই এক শান্ত, অপরূপা রূপ, যিনি তাঁর ‘জগৎকে ধারণকারী’ শক্তিতে ভক্তদের রক্ষা করেন। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে তাঁর আরাধনা শুরু হয়। এই পুজো বাংলার বহু স্থানে জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলেও, এর প্রারম্ভ নিয়ে নদীয়ার কৃষ্ণনগর এবং হুগলির চন্দননগরের মধ্যে আজও মতভেদ বিদ্যমান। তবে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর নেপথ্যে রয়েছে এক রাজা, তাঁর মনোবেদনা এবং এক অলৌকিক স্বপ্নাদেশের মন ছুঁয়ে যাওয়া কাহিনি।
নবাবের কারাগার ও মায়ের স্বপ্নাদেশ
সময়টা ছিল ১৭৫৪ সাল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় নবাব আলিবর্দী খানকে নির্দিষ্ট রাজকর দিতে না পারায় বন্দি হলেন কারাগারে। শোনা যায়, যখন তিনি মুক্তি পেয়ে ফিরে আসছেন, সেই সময়টি ছিল দুর্গোৎসবের কাছাকাছি। পথের মধ্যে জলঙ্গি নদীতে মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেখে রাজার মন বিষাদে ভরে উঠল। নিজের রাজ্যে দুর্গোৎসব করতে না পারার সেই মন খারাপ নিয়েই তিনি নৌকায় ঘুমিয়ে পড়লেন।
সেই গভীর ঘুমে রাজা পেলেন এক অলৌকিক স্বপ্নাদেশ। তিনি দেখলেন, কুমারী মেয়ে রূপে স্বয়ং মা জগদ্ধাত্রী তাঁকে দেখা দিচ্ছেন। ‘জগৎকে যিনি ধরে রাখেন’— সেই দেবী তাঁকে নির্দেশ দিলেন। এরপর রাজা কালবিলম্ব না করে তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রর কাছে ছুটে গেলেন কীভাবে পুজো করতে হবে তা জানতে। তান্ত্রিকের দেখানো পথ ধরেই শুরু হলো কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো।
কুমারী রূপ ও রাজবাড়ির বিশেষত্ব
সেই স্বপ্নাদেশের কারণেই কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির প্রতিমা অন্যান্য জগদ্ধাত্রীর থেকে অনেকটাই ছোট হয়ে থাকে। কারণ রাজা স্বপ্নে কুমারী রূপেই দেবীকে দেখেছিলেন। তাই আজও রাজবাড়িতে পুরনো নিয়ম মেনে ঘোড়ক রূপী সিংহ বাহিনী মা জগদ্ধাত্রীর পুজো হয়ে আসছে। একসময় কেবল রাজবাড়িতেই এই পুজো সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন ছোট-বড় মিলিয়ে কৃষ্ণনগর শতাধিক পুজোর আলোয় ঝলমলে হয়ে ওঠে।
একদিনের পুজো, বিশেষ বিসর্জন
এখানে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো হয় কেবল এক দিনেই (কার্তিক শুক্লা নবমীতে), যা চন্দননগরের চার দিনের পুজোর রীতির চেয়ে ভিন্ন। পরের দিন অর্থাৎ দশমীর দিনে দেবীর ভাসান হয়।
ভাসানের দিনেও কৃষ্ণনগরে রয়েছে এক স্বতন্ত্র ঐতিহ্য। প্রথমে সকালে মায়ের ঘট ভাসান হয় জলঙ্গি নদীতে। আর রাজবাড়ির মা জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা বিসর্জন হয় রাজারদিঘিতে। ভাসানের প্রথা অনুযায়ী, একসময় রাজা-রানিমা রাজবাড়িতে বসে ভাসানের ঠাকুর দেখতেন এবং তাঁদের পছন্দের ঠাকুরকে পুরষ্কৃত করতেন। সেই রীতি মেনেই আজও বিসর্জনের আগে রাজবাড়িতে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে রাখা হয়, আর তারপর সেখান থেকে ঘাটে ভাসানের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
নবাবের হাতে বন্দি রাজার বিষাদ থেকে শুরু হওয়া এই পুজো আজও বাংলার এক অনন্য আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে।



















