8 avatars of lord ganesha

ব্যুরো নিউজ ২৯ অক্টোবর ২০২৫ : প্রতিটি পূজা বা শুভ কর্মের শুরুতে কেন সর্বাগ্রে শ্রী গণেশকে পূজা করা হয়, তাহা আমাদের সকলেরই জানা। তবে আপনারা কি জানেন যে, মুদ্গল পুরাণ অনুসারে, গণেশ মানব স্বভাবের আটটি প্রধান ‘দোষ’ বা দুর্বলতার প্রতিমূর্তি স্বরূপ আটজন অসুরকে দমন করিতে আটটি অবতার বা রূপ ধারণ করিয়াছিলেন? এই দোষগুলি দেবতাগণের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল এবং সেই দুর্বলতা হইতেই অসুরদিগের জন্ম হইয়াছিল। প্রতিটি অবতারেই গণেশের গজমুণ্ড ও শুঁড় বিদ্যমান, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি তাঁহার বাহন মূষিককে ত্যাগ করিয়া অন্য পশু গ্রহণ করিয়াছেন।

এই আট অবতারের আখ্যানই আধ্যাত্মিক জীবনে আমাদের নিজেদের দুর্বলতাগুলিকে চিনিতে এবং সেগুলিকে জয় করিতে সাহায্য করে।

 

১. বক্রতুণ্ড (Vakratunda): প্রমাদ নাশ

গণেশের প্রথম অবতার বক্রতুণ্ড (যার অর্থ বক্র বা বাঁকা শুঁড়)।

  • দোষের উৎস: দেবরাজ ইন্দ্রের ‘প্রমাদ’ (heedlessness) বা অসাবধানতা হইতে মসরাসুর নামক অসুরের জন্ম হয়। মৎসর (Matsara) শব্দের অর্থ হইল ঈর্ষা ও স্বার্থপরতা।
  • বিজয়: মসরাসুর শিবের নিকট হইতে অভয় বর লাভ করিয়া তিন লোক জয় করেন। সকল দেবতা বক্রতুণ্ডকে আহ্বান করিলে, তিনি সিংহ বাহনে আসিয়া মসরাসুরের দুই পুত্রকে বধ করেন। অসুর তখন ভয়ে আত্মসমর্পণ করিলে প্রভু তাঁহাকে ক্ষমা করেন এবং তিন লোকে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
  • শিক্ষা: বক্রতুণ্ড অবতার আমাদের দেখান যে, আপনি যতই ক্ষমতাবান বা ধনী হোন না কেন, নিজের সীমা জানা ও বোঝা-তেই প্রকৃত জ্ঞান নিহিত।

 

২. একদন্ত (Ekadanta): মদ ও অহংকার নাশ

অসুর চ্যবনের পুত্র মদ (Mada), যিনি মদ বা মদিরা পান করিতে ভালোবাসিতেন, তিনি অসুরগুরু শুক্রাচার্য্যের নিকট বিদ্যা শিক্ষা করেন। মদাসুর দেবী হইতে বিশেষ শক্তি লাভ করিয়া, মদ ও অহংকারে মত্ত হইয়া তিন লোক জয় করিতে শুরু করেন।

  • দোষের উৎস: ‘মদ’ (intoxication) বা ঔদ্ধত্য।
  • বিজয়: দেবতাগণ সনৎকুমার ঋষির উপদেশে একদন্তকে আহ্বান করেন। মূষিক বাহনে উপবিষ্ট একদন্তের তেজ দর্শন করিয়া মদাসুর সাহস হারাইয়া আত্মসমর্পণ করেন।
  • শিক্ষা: এই অবতার আমাদের দেখায় যে, নেশা বা কোনো ঐশ্বর্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণহীন গর্বে পূর্ণ করিতে পারে।

Ganeshji : সিদ্ধিদাতা গণেশের চার হাতের রহস্য !

৩. মহোদর (Mahodara): মোহ ও ভ্রম নাশ

এই অবতারের দুই প্রকার গল্প প্রচলিত। মূল গল্প অনুসারে, সূর্যদেবের প্রতি ভক্তির কারণে মোহাসুর ‘দৈত্য রাজ’ নামে পরিচিত হন। অন্য গল্পে, শিবের ধ্যান ভঙ্গ করিতে সতী কর্তৃক ত্যাজ্য মনোমোহিনী শক্তি হইতেই মোহাসুর (Mohasura) রূপে ‘মোহ’ বা ভ্রম-এর জন্ম হয়।

  • দোষের উৎস: ‘মোহ’ (delusion) বা ভ্রম।
  • বিজয়: মহোদর রূপে গণেশ মূষিকে চড়িয়া আসেন। তখন শ্রীবিষ্ণুর উপদেশে মোহাসুর আত্মসমর্পণ করিয়া চিরকালের জন্য মহোদরের ভক্ত হন।
  • শিক্ষা: মোহ মানুষকে বাস্তবের পথ হইতে বিচ্যুত করিয়া ধ্বংসের দিকে ঠেলিয়া দেয়।

 

৪. গজানন (Gajanana): লোভ নাশ

একদা স্বর্গের কোষাধ্যক্ষ কুবের কৈলাসে দেবী পার্বতীকে কামাতুর দৃষ্টিতে দেখেন। পার্বতীর ক্রোধে কুবের কম্পিত হইলে, সেই কম্পন-শক্তি হইতে লোভাসুরের (Lobhasura) জন্ম হয়।

  • দোষের উৎস: ‘লোভ’ (Greed) বা লালসা।
  • বিজয়: ত্রিলোক জয়কারী লোভাসুরকে দমন করিতে ঋষি রৈভ্য দেবতাগণকে গজাননের উপাসনা করিতে বলেন। গজাননের আগমনেই লোভাসুর অনুশোচনায় পূর্ণ হইয়া ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
  • শিক্ষা: এই অবতার দেখায় যে, কামুকতা আত্ম-কেন্দ্রিক এবং অজ্ঞাতসারে আত্মার বিনাশ ঘটায়।

 

৫. লম্বোদর (Lambodara): ক্রোধ নাশ

সমুদ্র মন্থনের সময় বিষ্ণু যখন মোহিনীর রূপ ধারণ করেন, সেই রূপের কারণে শিবের মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়। সেই ক্রোধ হইতে জন্ম নেয় ক্রোধাসুর (Krodhasura)।

  • দোষের উৎস: ‘ক্রোধ’ (Anger) বা রাগ।
  • বিজয়: ক্রোধাসুরের ধ্বংসলীলা থামাতে গণেশ লম্বোদর রূপে আবির্ভূত হন। তাঁহার বৃহৎ উদর ক্রোধাসুরের সমস্ত ক্রোধকে ধারণ করিবার প্রতীক ছিল। লম্বোদর ক্রোধাসুরকে বশীভূত করিয়া শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
  • শিক্ষা: লম্বোদর শিক্ষা দেন যে ধৈর্য ও সংযমের দ্বারা ক্রোধকে জয় করা সম্ভব।

 

৬. বিকট (Vikata): কাম ও কামনা নাশ

দৈত্য জলন্ধরের পত্নী বৃন্দা ও শ্রীবিষ্ণুর অংশ হইতে কামাসুর (Kamasura)-এর জন্ম হয়, যিনি কামনা ও বাসনার ফলস্বরূপ।

  • দোষের উৎস: ‘কাম’ (Lust/Desire) বা প্রবল বাসনা।
  • বিজয়: মুদ্গল ঋষির উপদেশে দেবতারা ‘ওঁ’ মন্ত্র জপ করিলে বিকট অবতারের আবির্ভাব হয়। তিনি ময়ূর বাহনে আরোহণ করিয়া কামাসুরকে সহজে পরাজিত করেন।
  • শিক্ষা: কামনা বা বাসনার কোনো শেষ নাই। সন্তুষ্টি ও সুখ কোনো অর্জনের ফল নয়, বরং এটি একটি অভ্যন্তরীণ অবস্থা।

 

৭. বিঘ্নরাজ (Vighnaraja): মমত্ব ও আসক্তি নাশ

দেবী পার্বতীর হাস্য হইতে এক সুদর্শন বালকের জন্ম হয়। মমত্বে অভিভূত পার্বতী তাহাকে ‘মম’ (Mama) অর্থাৎ ‘আমার’ নাম দেন। সে পরে শম্বর নামক অসুরের প্রভাবে মমাসুর অর্থাৎ আসক্তির প্রতীক রূপে আবির্ভূত হয়।

  • দোষের উৎস: ‘মমত্ব’ (Attachment) বা প্রবল আসক্তি।
  • বিজয়: মমাসুরকে দমন করিতে গণেশ বিঘ্নরাজ অর্থাৎ ‘বাধা অপসারণকারী’ রূপে আবির্ভূত হন। তিনি মহান শেষনাগ বাহনে আরোহণ করিয়া আসক্তি-রূপী অসুরকে শান্ত করেন।
  • শিক্ষা: বিঘ্নরাজ আমাদের মনে করিয়ে দেন যে পার্থিব আসক্তিতে কোনো সুখ নাই। আত্মা কেবল সত্য এবং দিব্যতাকে খোঁজে, বাকি সব মায়া।

Ganeshji : মহোদরের সূক্ষ্ম বার্তা: গণেশের ভুঁড়ি আমাদের কী শেখায়?

৮. ধূম্রবর্ণ (Dhumravarna): অহংকার নাশ

ব্রহ্মা যখন তাঁহার পৌত্র সূর্যদেবকে ‘কর্ম জগৎ’-এর উপর শাসনভার অর্পণ করেন, তখন সূর্য গর্বিত হইয়া পড়েন। সেই গর্বিত চিন্তা হইতেই তাঁহার হাঁচি হইতে অহংকারাসুর (Ahamkarasura)-এর জন্ম হয়।

  • দোষের উৎস: ‘অহংকার’ (Ego) বা গর্ব।
  • বিজয়: অহংকারাসুরের শক্তি বৃদ্ধির ফলে ভীত দেবতাগণ গণেশকে আহ্বান করেন। গণেশ তখন ধূম্রবর্ণ রূপে মূষিকে আসিয়া গর্বিত অসুরকে পরাজিত করেন।
  • শিক্ষা: এই পর্বটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ‘অহং’ বা অহংকারই আত্ম-ধ্বংসের মূল কারণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর