ব্যুরো নিউজ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : দুর্গাপূজা শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি ভক্তি, জাঁকজমক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক মহা মিলন। এই উৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে দেবী দুর্গার এক শক্তিশালী কাহিনি, যিনি মহিষাসুরমর্দিনী রূপে মহিষাসুর নামক মহাবলশালী অসুরকে বধ করেছিলেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, এই চিরন্তন গল্পটি কেবল এক দেব-অসুরের যুদ্ধের বিবরণ নয়, বরং এটি ধার্মিকতা, সাহস এবং নারীশক্তির বিজয়গাথা।
মহিষাসুরের দম্ভ ও দেবতাদের অসহায়তা
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, মহিষাসুর কঠোর তপস্যার মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব বর লাভ করেছিল যে কোনো পুরুষ বা দেবতা তাকে বধ করতে পারবে না। এই বরের কারণে সে অত্যন্ত অহংকারী হয়ে ওঠে এবং তিন লোক জুড়ে তাণ্ডব শুরু করে। দেবতারা তার কাছে পরাজিত হন এবং মর্ত্যলোকে ভয় ছড়িয়ে পড়ে। দেবতারা যখন নিজেদের অসহায় দেখতে পেলেন, তখন তারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের কাছে সাহায্য চাইলেন। তখনই এক ঐশ্বরিক পরিকল্পনা অনুসারে এক সর্বশক্তিমান দেবীর সৃষ্টি হলো।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবসহ অন্যান্য দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে জন্ম নিলেন এক তেজস্বী যোদ্ধা – দেবী দুর্গা। প্রতিটি দেবতা তাকে অনন্য অস্ত্র দান করলেন: শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন সুদর্শন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ এবং অগ্নি দিলেন বর্শা। একটি ভয়ঙ্কর সিংহের উপর আরোহণ করে দেবী দুর্গা ‘শক্তি’র প্রতীক হয়ে উঠলেন, যা ঐশ্বরিক নারীসত্তা, সাহস, জ্ঞান এবং অদম্য শক্তির প্রতীক। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহিষাসুরের অত্যাচার বন্ধ করা।
Durga Puja : মহালয়া থেকে বিজয়া দশমী, ২০২৫ সালের দুর্গাপূজার সম্পূর্ণ নির্ঘণ্ট
মহিষাসুরের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ
দুর্গা এবং মহিষাসুরের মধ্যে এই যুদ্ধ চলেছিল টানা নয় দিন ও নয় রাত। এই যুদ্ধ ছিল তীব্র লড়াই, ঐশ্বরিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং মহাজাগতিক শক্তিতে ভরপুর। মহিষাসুর বিভিন্ন রূপ ধারণ করে যুদ্ধ চালিয়ে যায় – কখনও মহিষ, কখনও সিংহ, কখনও হাতি, আবার কখনও মানুষের রূপ নেয়, কিন্তু কোনো রূপেই সে দুর্গার শক্তির কাছে টিকতে পারল না। দশম দিনে দেবী তার ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরকে আঘাত করেন এবং তার ত্রাসের রাজত্ব শেষ হয়। এই মুহূর্তটিই দুর্গাকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অর্থাৎ মহিষাসুরকে বধকারী হিসেবে অমর করে তোলে।
Durga Puja : দুর্গা পুজোয় মেট্রোতেই স্বস্তি, ভিড় এড়িয়ে কলকাতার সেরা পুজাপরিক্রমা এক নিমেষে।
এই পৌরাণিক কাহিনীর গভীর তাৎপর্য
দুর্গার এই বিজয় শুধুমাত্র ভালো ও মন্দের, আলো ও অন্ধকারের, আশা ও হতাশার চিরন্তন জয়কে তুলে ধরে। দুর্গাপূজার সময় ভক্তরা দেবীকে শুধু একজন দেবী হিসেবে নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রামে শক্তি, ধৈর্য এবং অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পূজা করেন। এই উৎসব ঐশ্বরিক নারীশক্তির ক্ষমতাকে উদযাপন করে, যা মানবজাতিকে মনে করিয়ে দেয় যে ধার্মিকতা এবং সাহস সবসময়ই অত্যাচারের উপর জয় লাভ করবে।
আমাদের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন সাধারণ শক্তি ব্যর্থ হয়। সেই সময়ে এক ভিন্ন ধরনের শক্তিকে আহ্বান করা হয়, যা আধিপত্য থেকে নয়, বরং ভারসাম্য এবং সৃষ্টির চিরন্তন ছন্দ থেকে উদ্ভূত হয়। এই কারণেই দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয়েছিল। দুর্গার গল্প শুধু দেব-অসুরের যুদ্ধ নিয়ে নয়, এটি এমন এক শক্তির জাগরণ নিয়ে যা সুপ্ত থাকে যতক্ষণ না বিশ্বের তার প্রয়োজন হয়।
এই নয় রাতের যুদ্ধ কেবল একটি মহাজাগতিক সংঘাত নয়, এটি আমাদের ভিতরের যুদ্ধেরও প্রতিফলন। আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেই মহিষাসুর বাস করে, যা অহংকার, আলস্য এবং আত্মপ্রতারণার প্রতীক। এবং আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই দুর্গা বাস করেন, যা জাগরণের সাহস, প্রতিরোধ এবং ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার শক্তি। তার অস্ত্র কেবল ইস্পাতের তৈরি নয়, সেগুলি প্রতীক। ত্রিশূল হলো লক্ষ্য স্থির করার প্রতীক, তলোয়ার সত্যের প্রতীক, চক্র হলো স্বচ্ছতার প্রতীক এবং ধনুক হলো দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক।
দুর্গার এই গল্পটি কালজয়ী, কারণ এটি কোনো অতীতের ঘটনা নয়, বরং এক চিরন্তন সত্য। যখন অন্ধকার অতিরিক্ত শক্তিশালী হয়, তখন আলো ঠিকই মাথা তুলে দাঁড়ায়। যখন অহংকারকে অটল মনে হয়, তখন নম্রতা ও প্রজ্ঞা তাকে ভেঙে দিতে পারে। যখন কোনো পুরুষ সাহায্য করতে পারে না, তখন সৃষ্টির মধ্যে থাকা ঐশ্বরিক নারীসত্তা এগিয়ে আসে। দুর্গা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে প্রকৃত শক্তি কেবল বল প্রয়োগে নয়, বরং করুণা, সাহস, ধৈর্য এবং শক্তির ভারসাম্যে নিহিত। তার যুদ্ধ ছিল ধ্বংসের জন্য নয়, বরং ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য, জয় করার জন্য নয়, বরং জীবনের সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য।
এই জীবন্ত প্রজ্ঞা আমাদের বলে, জীবন নিজেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা রাখে। আমরা এই গল্পের থেকে আলাদা নই। যখনই আমরা ছলনার পরিবর্তে সত্যকে, উদাসীনতার পরিবর্তে শৃঙ্খলাকে এবং নিষ্ঠুরতার পরিবর্তে করুণাকে বেছে নিই, তখনই আমাদের মধ্যে দিয়ে দুর্গা কাজ করেন। তিনি যে অসুরদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, তারা আজও সূক্ষ্ম রূপে সমাজ, সম্পর্ক এবং আমাদের নিজেদের হৃদয়ে বিদ্যমান। আর তাদের পরাস্ত করার শক্তি আমাদের ভেতরেই অপেক্ষা করে। দুর্গা লড়াই করেছিলেন কারণ এমন কিছু যুদ্ধ আছে যা শুধুমাত্র ‘শক্তি’র পূর্ণতা দিয়েই জেতা যায়, এবং সেই পূর্ণতা প্রতিটি সত্তার মধ্যে থাকে, যে তা জাগিয়ে তোলার সাহস রাখে।