nandi garuda singhabahini

ব্যুরো নিউজ ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : মহাজাগতিক গর্জন থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীর নীরবতা পর্যন্ত, প্রাচীন কিংবদন্তিগুলোতে দেখা যায় ভগবান কোনো না কোনো দিগবিজয়ী পশুর পিঠে চড়ে ভ্রমণ করেন। এই প্রাণীগুলো কেবল বাহন নয়, বরং প্রতীক, রক্ষক এবং ঐশ্বরিক ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি। হিন্দু পুরাণে এই চিত্র আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যেখানে দেব-দেবীগণ প্রায়শই তাঁদের বাহনে সওয়ার হন – এই পবিত্র প্রাণীরা তাঁদের শুধু শারীরিকভাবেই বহন করে না, বরং আধ্যাত্মিক, প্রতীকী এবং মহাজাগতিকভাবেও ধারণ করে।

এই দৈব জীবরা কেবল গল্পের উপাদান নয় – তারা গভীর অর্থে সমৃদ্ধ, প্রায়শই দেবতার প্রকৃতি, গুণাবলী এবং এমনকি তাঁদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকেও প্রতিফলিত করে। প্রতিটি বাহন নিজের মধ্যে কিছু রহস্য বহন করে – যা ধর্ম, মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা, অভ্যন্তরীণ শক্তি এবং প্রাচীন পরিবেশগত চেতনার কথা বলে। আসুন, এমন ছয়টি পবিত্র প্রাণীর পেছনে গভীর অর্থ উন্মোচন করি, যারা দেবতাদের বহন করে চলেছে এবং সময়ের সাথে সাথে আমাদের কাছে সেই রহস্যগুলো ভবলীলায় পরিণত হচ্ছে ।

 

১. নন্দী – শিবের বাহন বৃষ

ধর্ম, শক্তি এবং ধৈর্যের প্রতীক

নন্দী, পবিত্র ষাঁড়, হলেন ভগবান শিবের অবিচল বাহন। কিন্তু নন্দী কেবল একজন ঐশ্বরিক বাহন নন – তিনি একজন দ্বাররক্ষক, একজন নিবেদিত শিষ্য এবং অটল বিশ্বাসের প্রতীক।

বৃষ ধর্ম বা মহাজাগতিক আইনকে উপস্থাপন করে, যা এই মহাবিশ্বকে ধারণ করে রেখেছে। তাঁর অদম্য শক্তি এবং ধৈর্যশীল মনোভাবের মাধ্যমে নন্দী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিনাশের (শিবের ভূমিকা) আগে অধর্মের (অসততা) উপর নির্মিত পুরোনো কাঠামো ভেঙে পড়া প্রয়োজন। প্রতিটি মন্দিরে শিবলিঙ্গের সামনে নন্দীর শান্ত দৃষ্টি এক শাশ্বত বার্তা দেয়: অভ্যন্তরীণ শক্তি আসে স্থিরতা, শৃঙ্খলা এবং উদ্দেশ্য থেকে।

গোপন রহস্য: নন্দীকে প্রায়শই প্রথম যোগী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যিনি নীরবে শিবের জ্ঞান তাঁদের কাছে পৌঁছে দেন, যারা তা শুনতে পারেন। তাঁর স্থিরতা শূন্যতা নয় – বরং তা পরিপূর্ণতারই প্রতিফলন। তিনি আমাদের শেখান যে, ভক্তি কোলাহল নয়;  হল উপস্থিতি।

সনাতন ধর্মের মহাজাগতিক সংহতি : বিষ্ণুর অবতার ও নবগ্রহ

২. গরুড় – বিষ্ণুর বাহন ঈগল

গতি, সার্বভৌমত্ব এবং সুরক্ষার প্রতীক

গরুড়, শক্তিশালী ঈগল, কেবল ভগবান বিষ্ণুর বাহক নন – তিনি একজন যোদ্ধা, একজন রক্ষক এবং একজন স্বতন্ত্র স্বর্গীয় সত্তা। তাঁর মা বিনতাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য জন্ম নেওয়া গরুড়, বন্ধন এবং অজ্ঞতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক।

তাঁর বিশাল ডানা এবং তীক্ষ্ণ চোখ ঐশ্বরিক কর্মের দৃষ্টি ও দ্রুততাকে প্রকাশ করে। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে গরুড়কে সর্প থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আহ্বান করা হয় – এটি কেবল আক্ষরিক সর্প নয়, বরং কামনা, অহংকার এবং মায়ার মতো রূপক সর্প, যা আত্মাকে আঁকড়ে ধরে। বিষ্ণু, যিনি এই মহাবিশ্বকে রক্ষা করেন, গরুড়ের উপর সওয়ার হয়ে আমাদের কাছে এই ধারণাটি পৌঁছে দেন যে, যখন ধর্ম বিপন্ন হয়, তখন দ্রুত সুরক্ষা প্রয়োজন।

গোপন রহস্য: গরুড় কেবল আত্মসমর্পণ থেকে বিষ্ণুর সেবা করেন না – বরং করেন ভালোবাসা এবং নির্বাচিত আনুগত্য থেকে। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, ঐশ্বরিক সেবা মানে শক্তির আত্মসমর্পণ নয়, বরং উচ্চতর আদর্শের সাথে তার সমন্বয় সাধন

 

৩. মূষিক – গণেশের বাহন ইঁদুর

নম্রতা, নিয়ন্ত্রণ এবং অভ্যন্তরীণ বিজয়ের প্রতীক

সম্ভবত সব বাহনের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হল ছোট্ট ইঁদুর, যা হস্তীমুখ গণেশকে বহন করে। কেন এত বিশাল একজন সত্তা এত ছোট প্রাণীর পিঠে চড়বেন? এর উত্তর রয়েছে প্রতীকী প্রতিভার মধ্যে।

ইঁদুর একটি অন্ধকার জগতের প্রাণী, যা ছোট ছোট স্থানে ঢুকে পড়ার জন্য পরিচিত – এটি অস্থির মন, কৌতূহল এবং সেই সমস্ত বাসনাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা আমাদের অজান্তেই ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে খায়। গণেশের ইঁদুরের উপর সওয়ার হওয়া হাস্যকর নয় – এটি এক মহৎ প্রতীক। এটি আমাদের শেখায় যে, সত্যিকারের জ্ঞান নিম্ন প্রবৃত্তিগুলোকে গুঁড়িয়ে দেয় না, বরং তাদের বশ করে এবং তাদের উপর সওয়ার হয়। মন, ইঁদুরের মতোই, ধ্বংসাত্মক বা ঐশ্বরিক হতে পারে – এটি নির্ভর করে কে এর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে তার ওপর।

গোপন রহস্য: মূষিক আমাদের কানে কানে বলে যে, ক্ষুদ্রতম প্রাণীও ঐশ্বরিক শক্তি ধারণ করতে পারে – যদি তা জ্ঞানের কাছে সমর্পিত হয়। বাধা দূর করার চাবিকাঠি বাহ্যিক শক্তিতে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ আয়ত্তে রয়েছে।

 

৪. ময়ূর – কার্তিকেয়ের বাহন

বিজয়, সৌন্দর্য এবং অহং-এর ঊর্ধ্বে ওঠার প্রতীক

ভগবান কার্তিকেয় (যিনি মুরুগান বা স্কন্দ নামেও পরিচিত), যিনি যুদ্ধের দেবতা, তাঁর বাহন ময়ূর হল সৌন্দর্য, গর্ব এবং অহংকারের প্রতীক। তবুও, কার্তিকেয় তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান – এটি এক শক্তিশালী চিত্র, যা অহংকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার ধারণাকে প্রকাশ করে।

ময়ূরের পালক সমস্ত রঙের উজ্জ্বলতা বহন করে, কিন্তু তাতে হাজার চোখের চিহ্ন থাকে – যা সচেতনতা, সতর্কতা এবং অভ্যন্তরীণ অন্ধকারের উপর বিজয়ের প্রতীক। এই পাখি, প্রায়শই যা কামনার সাথে যুক্ত, তা এমন একজন দেবতার বাহন, যিনি অসুরদের বিনাশ করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছেন – যা বোঝায় যে শক্তিকে দমন করা উচিত নয়, বরং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা উচিত।

গোপন রহস্য: কার্তিকেয়ের ময়ূর আমাদের দেখায় যে, গর্বকে গুঁড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং তাকে শুদ্ধ করা প্রয়োজন। সৌন্দর্যও ঐশ্বরিকের সেবা করতে পারে, যখন তা অহংকার ত্যাগ করে এক উজ্জ্বল নম্রতায় পরিণত হয়।

 

৫. সিংহ – দুর্গার বাহন

ভীষণ করুণা, সাহস এবং ধার্মিক ক্রোধের প্রতীক

যখন দেবতারা মহিষাসুরের বিরুদ্ধে অসহায় ছিলেন, তখন দেবী দুর্গা অগ্নিময় শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হন – এবং তিনি এক সিংহের পিঠে চড়ে এসেছিলেন। এই পশু, বনের রাজা, কেবল একটি বন্য শক্তি নয়, বরং এক সুশৃঙ্খল তিব্রতা , যা ঐশ্বরিক নারীশক্তির মাধ্যমে প্রবাহিত হয়।

সিংহ নির্দয়তা ছাড়াই প্রচণ্ডভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে প্রতিনিধিত্ব করে, ঘৃণা ছাড়াই ধ্বংস করার শক্তিকে প্রকাশ করে। দুর্গার সিংহ আমাদের কাছে শক্তির (ঐশ্বরিক নারী শক্তি) পূর্ণ রূপটি দেখায় – যিনি বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হতে ভীত নন, তবুও মহাজাগতিক ভারসাম্যে স্থির থাকেন।

গোপন রহস্য: সিংহ তাঁর দাস নয়, বরং তাঁর প্রতিচ্ছবি – যা সেই বন্য অভ্যন্তরীণ শক্তিকে প্রতীকী করে, যার উপর আমাদের চড়তে হবে, তাকে দমন না করে। দুর্গা কেবল একাই অসুরকে বধ করেন না; তিনি নিজের বিধ্বংসী সত্ত্বাকেও  যুদ্ধে নিয়ে যান।

 

৬. ঐরাবত – ইন্দ্রের বাহন হাতি

রাজকীয়তা, বৃষ্টি এবং মহাজাগতিক কর্তৃত্বের প্রতীক

ঐরাবত, সাদা হাতি, যা দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে বহন করে, সে সমুদ্র মন্থনের সময় মহাজাগতিক সমুদ্র থেকে জন্মগ্রহণ করে। একাধিক শুঁড় এবং উজ্জ্বল ত্বক নিয়ে সে কোনো সাধারণ প্রাণী নয় – সে একটি মেঘ-হাতি, যা বৃষ্টি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে।

হাতি স্মৃতি, প্রজ্ঞা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। ঐরাবতের বৃষ্টির সাথে সংযোগ ঐশ্বরিক কর্তৃত্বের জীবনদানকারী এবং ধারণকারী প্রকৃতিকে নির্দেশ করে। ইন্দ্র, প্রায়শই যাকে ত্রুটিপূর্ণ হিসাবে চিত্রিত করা হয়, তিনি এমন একটি হাতির উপর সওয়ার হন, যা প্রতীকীভাবে দেখায় যে রাজা এবং নেতাদের কিসের জন্য চেষ্টা করা উচিত: শক্তি ও প্রতিপালনের ভারসাম্য।

গোপন রহস্য: বলা হয় যে ঐরাবত স্বর্গের দ্বার রক্ষা করে – অস্ত্রের সাহায্যে নয়, বরং তার উপস্থিতির মাধ্যমে। সত্যিকারের শক্তি কেবল গর্জায় না , সাথে বর্ষায়

Brahma ; সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সীমিত উপাসনা: এক বিস্ময়কর রহস্য !

তারা কেবল দেবতাদেরই বহন করে না, বহন করে আরও অনেক কিছু

এই পবিত্র প্রাণীগুলো কেবল প্রাচীনতার জন্য পবিত্র নয়, বরং তাদের গভীর সত্যের জন্যই পবিত্র। তারা আমাদের কাছে প্রকাশ করে যে, ঐশ্বরিক শক্তি কখনো একা ভ্রমণ করে না। প্রতিটি বাহন একটি রূপক, যা দেবতারা আয়ত্ত করেছেন – এবং যা আমাদেরও আয়ত্ত করতে হবে।

সেটা নন্দীর ধৈর্য হোক, গরুড়ের গতি, মূষিকের মন, ময়ূরের গর্ব, সিংহের হিংস্রতা, বা হাতির শক্তি – প্রতিটি প্রাণী একটি রহস্য, একটি শিক্ষা, জ্ঞানের দিকে একটি প্রবেশদ্বার বহন করে।

এমন এক সময়ে, যখন মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, এই পৌরাণিক কাহিনীগুলো একটি সুপ্রাচীন সত্য তুলে ধরে : প্রাণীগুলো আমাদের থেকে নিন্ম নয় ; তারা প্রবৃত্তিতে আমাদের সমতুল্য  – দেবতাদের বহন করে, এবং সম্ভবত আমাদের নিজেদের ভুলে যাওয়া সত্তাকেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর