প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, ৬ মার্চ: অবশেষে যা হওয়ার তাই হল। শুধু মাঝখানের কয়েকটা দিন বিভিন্ন একাঙ্ক নাটক মঞ্চস্থ হল বঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চে। তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাক্তন রাষ্ট্রমন্ত্রী তাপস রায় তৃণমূল ছেড়ে ভাগলবা। আর গেলেন তো গেলেন একেবারে তৃণমূলের রাজনৈতিক জাত শত্রু বিজেপিতে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস এখন কার্যত ভাঙা হাটের মত। কখন যে কে গ্রেফতার হচ্ছে, কখন যে কে দল ভাঙিয়ে বিপুল টাকা তোলাবাজি করে ইনকাম ট্যাঙ্ক, ইডি বা সিবিআই হানার মুখে পড়ছে তা কারোরই জানা নেই। কিন্তু দলের মধ্যে এক দল শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন যারা এই সবই ভবিতব্য জেনেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কারন টা কি জানেন? কারন টা হল, দলের এখন দুটো মাথা। ক্যামাক স্ট্রীট থেকে চলছে যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসকে বেশি মান্যতা দেওয়া হবে? নাকি কালীঘাটের ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীটের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্যালয়ে কোথায় গিয়ে জানাবেন অভিযোগ? যদি বা জানান তা শুনবে কে? চিঠি দিলে ওই পর্যন্তই। এ যেনও ‘দিদিকে বল’ অথবা ‘ এক ডাকে অভিষেকে’র মত। ঘটা করে সব ঘোষণা হল বটে কিন্তু তারপরে আর দেখভালের কেউ নেই। যেনও পিসি সরকারের ম্যাজিক। এই আছে তো এই নেই। বিরক্ত তাপস রায় চাঁচাছোলা ভাষায় ঠিক সেই কথাটাই বললেন বুধবার। স্বখেদে বললেন বহু অভিযোগ জানিয়েছি। কেউ শোনারও নেই। কেউ উত্তর দেওয়ারও নেই। দুই নেতা- নেত্রী প্রায়ই ধরা ছোঁয়ার বাইরে অথবা হিমালয়ের সন্ন্যাসীর মত উদাসীন। তাপস রায়েরা তৃণমূলকে যে ভাইব্রান্ট দেখে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে এসেছিলেন আজ তার মোহ ভঙ্গ হয়েছে।
পদ্মাসনে তাপস
বেশ কিছু কাল ধরেই তৃণমূলের নানা দুষ্কৃতী ধরা পড়া, দুর্নীতির কারনে মন্ত্রীর গ্রেফতার হওয়া, বেআইনি বিপুল অর্থ উদ্ধার আবার হঠাৎই ১০ আনা, ৬ আনা চুল ছাঁটা কিছু যুব নেতার দাপাদাপিতে বিরক্ত হয়েছিলেন তাপস। আর সন্ধ্যেবেলা টিভি ক্যামেরার সামনে দলের হয়ে বলতে গিয়ে রোজই যেনও খাবি খাচ্ছিলেন একদা সোমেন মিত্রর অনুগামী এই নেতা। রাজনীতির ময়দানে ঘোরাফেরা করা সাধারন মানুষ বুঝছিলেন যে তাপস রায় দলের সাফাই গাইতে যা বলছেন তা তার মনের কথা নয়। বোধহয় দলের মধ্যেই অপমানিত হওয়ার ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু, শেষমেশ সত্যি তার ‘শ্বাসকষ্ট’ হচ্ছিল। তার চেয়েও অনেক অযোগ্য ব্যক্তি মন্ত্রিত্ব পেয়ে গেছেন। এমন অনেক পূর্ণ মন্ত্রী আছেন যারা তার মত ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসেননি। কিন্তু তবুও তারা দলের শীর্ষ দুই নেতার কাছে ‘ফাস্ট চয়েস’। তাপস বলছেন সেখানেও তিনি ব্রাত্য। তিনি যে তৃণমূল ছেড়ে অন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন সেটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু বিজেপিতে কেন? কারন শেষ দিকে তার তীব্র লড়াই ছিল উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। বাছাবাছা বিশেষণ প্রয়োগ করেছিলেন সুদীপের বিরুদ্ধে। বলে ছিলেন, সাদা হাতি, সাড়ে তিন বছর জেল খাটা আসামী। নন-প্রোডাক্টিভ, চিটফান্ডের সঙ্গে যুক্ত, বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তার গোপন আঁতাত। তার বাড়িতে ইডি হানার কারিগর। এত শতর পরেও পাল্টা রা-কাড়েননি সুদীপ। দলের শীর্ষ দুই নেতা বিস্ময়কর ভাবে চুপ।
‘রাজ্যের ভোটার তালিকা নির্ভুল’ | শুভেন্দুর অভিযোগে সাফ জবাব নির্বাচন কমিশনের
দলের এক মুখপাত্রকে নিয়ে ব্যপারটা মেটানোর চেষ্টা হচ্ছিল। কিন্তু সেও তো সাড়ে তিন বছর জেল খাটা। বিরোধী দলনেতা নাম না করে বলছেন, যে ওতো নরকের কীট। ওর কথার উত্তর দেব না। আর সত্যি এই কীর্তিমান মুখপাত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে। সারদা মামলায় গ্রেফতার হয়ে যিনি আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, সারদার বড় বেনিফিসিয়ারি হচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকে সামনাসামনি বসিয়ে জেরা করা হোক, সেই কীর্তিমানকে আর বিশ্বাসযোগ্য বলে কেউ মনে করেন না। কিন্তু, দল তাকে আবার মুখপাত্র করেছে। অবশ্য তাতে নেতা – নেত্রীর কিছু অসুবিধা না হলেও দলকে যারা প্রথম থেকে ভালবেসেছেন তারা বিরক্ত। সেদিন থেকেই তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। আর দলের অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতারা নিত্য অপমানিত হচ্ছিলেন ওই যুবার নামে দলে হঠাৎ ঢুকেপড়া চৌর্যবৃত্তিতে হাত পাকানো কিছু অশিক্ষিতের হাতে। সন্ধ্যে হলেই ক্যামেরার সামনে কিছু অর্ধ শিক্ষিত, অল্পবয়সী ছোকরা দলের হয়ে যুক্তির জাল বুনছিলেন। সেসবই রাজ্যবাসীর কাছে বেমানান লাগছিল। রাজ্যের সাধারন ভোটার থেকে শিক্ষিত মানুষরা বুঝছিলেন তৃণমূল নামক নৌকার পাল ছিঁড়ে গেছে। বেহাল নৌকা ঝড়ে ডুববে। কিন্তু, মুখ খোলার সাহস দেখাননি কেউ। তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের বাড়িতে হয় পুলিশি হানা না হয় উঠতি ছেনো-মস্তানদের হুমকি শুরু হয়ে যাবে । আর সেখনেই তাপস রায়কে দিতে হবে ১০০ -র মধ্যে লেটার মার্কস। কারন, তিনি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা রাখেন। ভয়ে গুটিয়ে না গিয়ে সত্য কথাটা বলে ফেলেছেন। দলের অনেক ত্রুটি- বিচ্যুতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। অগত্যা মিডিয়ার কাছে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দল ছেড়ে সোজা পদ্মাসনে।