ব্যুরো নিউজ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : সম্প্রতি, রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে (UNGA) ভাষণ দেওয়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত ও চিনকে ইউক্রেন যুদ্ধের “প্রাথমিক অর্থদাতা” হিসেবে চিহ্নিত করেন, কারণ তারা রাশিয়া থেকে তেল কেনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায়, আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতের উপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ভারত “অযৌক্তিক ও অন্যায়” বলে নিন্দা জানিয়েছে।
তবে, এর ঠিক বিপরীতে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন, ভারত “বেশিরভাগই” ইউক্রেনের পক্ষে আছে। তার এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের জটিলতা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থানকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে।
জেলেনস্কির দৃষ্টিকোণ: ভারত ইউক্রেনের বন্ধু?
নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে একটি সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার উপর জোর দেন। তিনি বলেন, “আমি মনে করি ভারত বেশিরভাগই আমাদের সঙ্গে আছে।” তিনি আরও বলেন যে, ভারতের রাশিয়ান জ্বালানি খাতের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তন করা উচিত এবং এই লক্ষ্যে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো উচিত। জেলেনস্কি এও মন্তব্য করেন যে, এই বিষয়ে চিনের সঙ্গে আলোচনা করা আরও কঠিন, কারণ বেইজিং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার প্রতি সংবেদনশীল।
আশ্চর্যজনকভাবে, জেলেনস্কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন যে ট্রাম্প ইউক্রেনকে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সমর্থন জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন যে, ট্রাম্পের এই “স্পষ্ট বার্তা” তাকে ইতিবাচকভাবে অবাক করেছে। জেলেনস্কি মনে করেন, ট্রাম্পও তার মতোই দ্রুত যুদ্ধ শেষ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তা চান না।
ট্রাম্পের অবস্থান: ভারত কি যুদ্ধের অর্থদাতা?
ট্রাম্প তার ভাষণে ভারত ও চিনকে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রধান অর্থদাতা হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “রাশিয়ান তেল কিনে চিন ও ভারত এই চলমান যুদ্ধের প্রধান অর্থদাতা।” এই মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যা বর্তমানে ভারতের ওপর আরোপিত মোট শুল্ক ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ভারত এটিকে “অন্যায় ও অযৌক্তিক” আখ্যা দিয়েছে এবং নিজেদের জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন ও ভারতের ভূমিকা
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও রাষ্ট্রসংঘে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে সংঘাত নিরসনে ভারত একটি “খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা” পালন করতে পারে। মেলোনির এই মন্তব্য ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন। সম্প্রতি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মেলোনির মধ্যে টেলিফোনে আলাপচারিতায় ইউক্রেন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং ভারত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।
উপসংহার: ভারতের কূটনৈতিক ভারসাম্য
যুদ্ধ-কালীন বিশ্বে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এক স্থিতিশীলকারী শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ভারত একদিকে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বজায় রেখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে ইউক্রেন সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্পের মতো কিছু পশ্চিমা নেতার যুদ্ধের মুনাফা সর্বোচ্চ করার চেষ্টা বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। ভারত-ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) নিয়ে আলোচনা এবং ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (IMEEEC) উদ্যোগের মতো পদক্ষেপগুলি ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ। বিশ্ব যখন নতুন করে সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে, তখন ভারতের এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করছে।