শুদ্ধাত্মা মুখার্জি , ০৫ নভেম্বর ২০২৫ : প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক পদক্ষেপেই আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে দেখা দিয়েছে এক বিশাল বৈপরীত্য। একদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার জিয়ংজুতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠককে তিনি “তৃষ্ণা শান্তি আলোচনা” হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে, ক্যারিবীয় সাগরে ভেনেজুয়েলার উপকূলে শুরু করেছেন ১৯৬২ সালের কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর আমেরিকার বৃহত্তম নৌ-সামরিক সমাবেশ। এই দুই পদক্ষেপের মধ্যে সঙ্গতি খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।
শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ‘বিস্ময়কর’ বোঝাপড়া
চীনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ফেন্টানিল সংক্রান্ত চীনা পণ্যের উপর শুল্ক ২০% থেকে কমিয়ে ১০% করা হবে। তাঁর দাবি, চীন-আমেরিকার এই পুরনো বিবাদ “নিষ্পত্তি” হয়েছে এবং তিনি মনে করেন শি জিনপিং ফেন্টানিল-সম্পর্কিত মৃত্যু রুখতে “খুব কঠোর পরিশ্রম করবেন।”
- রেয়ার আর্থ চুক্তি: এছাড়াও, বিরল মৃত্তিকা খনিজ (Rare Earth Minerals) সরবরাহ নিয়ে এক বছরের জন্য, যা পরবর্তীতে বাড়ানো যেতে পারে, একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
- ইউক্রেন যুদ্ধ: দুই নেতা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং “কিছু একটা করার জন্য” একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন।
- তাইওয়ান প্রসঙ্গ: ট্রাম্প স্পষ্ট করে দেন, এই বৈঠকে তাইওয়ানের বিষয়টি “একবারও উত্থাপিত হয়নি।”
কিন্তু যে ফেন্টানিল এই মুহূর্তে আমেরিকায় অতিরিক্ত মাত্রায় মাদক সেবনের মৃত্যুর প্রধান কারণ (৫৭,০০০ এর বেশি মৃত্যু), তার মূল কাঁচামাল উৎপাদনে চীনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ‘মেজর’স লিস্টেও এই ছাড়াও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে মাদক বা মাদক-পূর্ব রাসায়নিকের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে চীনকে ফেন্টানিল ইস্যুতে ছাড় দেওয়া হলো, সেখানে মাদকবিরোধী অভিযান হিসেবেই কেন ভেনেজুয়েলার উপর সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড়।
ক্যারিবীয় সাগরে ট্রাম্পের ‘হত্যা’ ঘোষণা
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টতই ঘোষণা করেছেন, ক্যারিবীয় সাগরে মাদকবাহী নৌকাগুলির বিরুদ্ধে সামরিক স্ট্রাইক চালিয়ে “যারা আমাদের দেশে মাদক নিয়ে আসছে, তাদের আমরা মেরে ফেলব।”
- সামরিক সজ্জা: পেন্টাগন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড (USS Gerald R. Ford) এবং এর স্ট্রাইক গ্রুপ-সহ একাধিক রণতরী ক্যারিবীয় সাগরে পাঠিয়েছে। পুয়ের্তো রিকো-তে পাঠানো হয়েছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান।
- লক্ষ্য ভেনেজুয়েলা: হোয়াইট হাউসের দাবি, এই অভিযান মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। তবে এখন পর্যন্ত আঘাত হানা ১৪টি নৌকা ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এই অভিযানে ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। মজার বিষয় হলো, প্রশাসন এখনও পর্যন্ত এই নৌকাগুলোতে মাদক পাওয়ার কোনো প্রমাণ প্রকাশ করেনি।
- আইন প্রয়োগ বনাম সামরিক হামলা: সাধারণত আন্তর্জাতিক জলসীমায় সন্দেহভাজন মাদকবাহী জাহাজকে মার্কিন কোস্ট গার্ড আটক করে, ক্রুদের গ্রেফতার করে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয়। কিন্তু বর্তমান অভিযানে নৌকাগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে এবং ক্রুদের হত্যা করা হচ্ছে। অনেক আইনি বিশেষজ্ঞ এই কাজকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে আইন প্রয়োগকারী কাজ থেকে বিরত রাখার আইন Posse Comitatus Act-এর লঙ্ঘন হতে পারে।
Donald Trump : মার্কিন রাষ্ট্রপতির নির্দেশে প্রায় ৩০ বছর পর গোটা বিশ্বে পুনরায় শুরু হতে চলেছে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা !
তেল না ফেন্টানিল: কেন ভেনেজুয়েলা আমেরিকার লক্ষ্য?
ফেন্টানিল এবং কোকেন—দুটোই আমেরিকার জন্য বড় সমস্যা। কিন্তু ভেনেজুয়েলা এই দুটির প্রধান উৎপাদক নয়, এটি মূলত একটি স্থানান্তর পথ হিসেবে কাজ করে। যেখানে কোকেনের প্রধান পাচারের রুট প্রশান্ত মহাসাগরে, সেখানে ক্যারিবীয় সাগরে ভেনেজুয়েলার উপর এই বিশাল সামরিক অভিযান স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের সৃষ্টি করে।
বিশ্লেষকদের মতে, মাদক নিয়ন্ত্রণের চেয়েও ট্রাম্প প্রশাসনের মূল লক্ষ্য ভিন্ন হতে পারে।
১. রেজিম চেঞ্জ (Regime Change): ট্রাম্প এবং তার উপদেষ্টাদের কথায় বারবার ইঙ্গিত মিলেছে যে তাদের বৃহত্তর উদ্দেশ্য হলো নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। মাদুরোর বিরুদ্ধে ‘কার্টেল দে লস সোলস’ (Cartel de los Soles) নামের একটি অপরাধী নেটওয়ার্কের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২. ‘নার্কো-টেররিস্ট’ তকমা: মাদুরো সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘নার্কো-টেররিস্ট’ বা ‘ট্রেন দে আরাগওয়া’ (Tren de Aragua) গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে মার্কিন প্রশাসন, যদিও এই গোষ্ঠীর কার্যকলাপের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মার্কিন আইনে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা এবং সাবেক কর্মকর্তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে এই সামরিক পদক্ষেপের পেছনে কোনো সুসংগঠিত কৌশল বা উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।
প্রশ্ন থেকেই যায়, যে ফেন্টানিলের কাঁচামাল উৎপাদনে চীন এবং ভারত বড় ভূমিকা রাখছে, সেই চীনকে শুল্কের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে কেন ভেনেজুয়েলার মতো একটি দেশকে পুরোমাত্রায় সামরিক নিশানায় আনা হচ্ছে? এই অভিযান কি নিছকই মাদকবিরোধী যুদ্ধ, নাকি তেল এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক নতুন খেলা, যেখানে রাশিয়া ইউক্রেনে যেমন ‘বিশেষ অভিযান’ ঘোষণা করেছিল, তেমনই আমেরিকাও ভেনেজুয়েলায় ‘বিশেষ অপারেশন’ হিসেবে এই সামরিক তৎপরতাকে চিহ্নিত করতে চাইছে?



















