ব্যুরো নিউজ, ১৫ই ডিসেম্বর ২০২৫ : দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে দেবী পার্বতীর বিবাহকে কেবল একটি পৌরাণিক কাহিনি বা রোমান্টিক মিলন হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এই বন্ধন আসলে মহাজাগতিক ভারসাম্যের প্রতীক, যেখানে স্থির চেতনা (শিব) এবং সক্রিয় শক্তি (পার্বতী) একে অপরের পরিপূরক। এই মিলন আমাদের শেখায় যে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়—সবকিছুর মূলে রয়েছে এই দুই মৌলিক সত্তার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
স্থিরতা (শিব) এবং গতি (শক্তি): সৃষ্টির মূল ভিত্তি
শিবকে প্রায়শই পরম বৈরাগী, বিশুদ্ধ চেতনা, অনড় ও ধীর রূপে কল্পনা করা হয়। অন্যদিকে পার্বতী (বা শক্তি) হলেন সেই চালিকা শক্তি, যা জীবন, রূপান্তর এবং সৃষ্টির মূল উৎস।
পার্বতী ছাড়া শিব: পার্বতীর শক্তি ছাড়া শিবের ক্ষমতা নিথর, সুপ্ত হয়ে থাকে। তিনি ধ্যানমগ্ন পর্বত, মহৎ কিন্তু নিশ্চল।
শিব ছাড়া পার্বতী: শিবের স্থিরতা না থাকলে পার্বতীর অফুরান শক্তি দিকভ্রষ্ট, গন্তব্যহীন হয়ে ওঠে।
এই পুরুষ ( Entity ) এবং প্রকৃতি (Nature/Energy)-এর মিলনই প্রমাণ করে যে, এই দুই সত্তা অবিচ্ছেদ্য এবং পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের একত্রীভূত রূপই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গতিপথ নির্ধারণ করে।
Lord Shiva : গৃহস্থ জীবনে শিবের সান্নিধ্য: মনের শান্তি ফেরাতে ৫টি অব্যর্থ সহজ দৈনন্দিন অভ্যাস
রূপান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্তি: তপস্যা ও নিষ্ঠা
পার্বতী তাঁর বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে নয়, বরং কঠোর তপস্যার মাধ্যমে শিবের মন জয় করেন। তাঁর এই তপস্যা (তীব্র তপস্যা) কেবল ব্যক্তিগত প্রেমের জন্য ছিল না, এটি ছিল তাঁর গভীর প্রকৃতি (শক্তি)-এর সঙ্গে মহাজাগতিক চেতনার সংযোগ স্থাপন।
পার্বতী যখন এই অটল ভক্তি ও আত্মত্যাগ দেখান, তখন তিনি কেবল একজন বধূ হিসেবে শিবের কাছে আসেননি, এসেছিলেন মহাবিশ্বের সহ-সৃষ্টিকর্তা হিসেবে। এই তপস্যা আমাদের শেখায় যে, আধ্যাত্মিক পথে সাফল্য লাভ করতে গেলে বাহ্যিক আকর্ষণ নয়, অভ্যন্তরীণ রূপান্তর এবং সংকল্প জরুরি।
মানবরূপী দেবত্ব: সেতু বন্ধন
যদিও পার্বতী স্বয়ং দেবী, পুরাণে তাঁকে প্রায়শই মানবী রূপে—রাজকন্যা, ভক্ত, হিমালয়ের কন্যা হিসেবে—দেখা যায়। দেবত্বের এই মানবরূপ কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একটি সেতু। তাঁর তপস্যা, অপেক্ষা, এবং ত্যাগ মানুষের কাছে সহজবোধ্য হয়।
পার্বতীর এই মানবীয় প্রকাশ আমাদের ধৈর্য, বিনয়, ভক্তি এবং রূপান্তরের শিক্ষা দেয়। এই কাহিনি আমাদের বোঝায় যে, আধ্যাত্মিক শক্তি পেতে হলে আমাদের জীবনকে ত্যাগ করতে হয় না, বরং মানবীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সেই শক্তি অর্জন করা সম্ভব।
KaalBhairav Shiva : কাশীর কোতোয়াল: বাবা কাল ভৈরবের অসীম মহিমা ও ভৈরবাষ্টকম্-এর শক্তি
জীবনের জন্য একটি নকশা: যোগ ও ভোগের ভারসাম্য
শিব-পার্বতীর মিলন কেবল দেবতাদের জন্য নয়, আমাদের মানব জীবনের জন্যও একটি আদর্শ। আমাদের জীবনেও স্থিতি (মনন, ধ্যান, আত্ম-পর্যালোচনা) এবং গতি (কর্ম, সম্পর্ক, উদ্যোগ)-এর মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন।
এই মহাজাগতিক দম্পতি আমাদের শেখান যে, আত্ম-সচেতনতার পূর্ণতা লাভ করতে গেলে এই দুটিরই প্রয়োজন:
ভেতরের শান্ত দ্রষ্টা (আমাদের শিব)
পৃথিবীর সক্রিয় অংশগ্রহণকারী (আমাদের পার্বতী)
এই পবিত্র মিলন আমাদের একটি গভীর বার্তা দেয়: আধ্যাত্মিক জাগরণ জাগতিক সম্পর্ক বা কর্ম ত্যাগ করে আসে না। বরং, আধ্যাত্মিকভাবে transcendent (উচ্চতর) হয়েও প্রেমের সাথে, দায়িত্ব নিয়ে এবং সৃজনশীলভাবে জগতে অংশগ্রহণ করাই হল জীবনের পূর্ণতা।
এই কাহিনি আমাদের বিবাহের ধারণাটি পুনর্চিন্তা করতে উৎসাহিত করে: এটি শুধু একটি সামাজিক চুক্তি বা রোমান্টিক বন্ধন নয়, বরং শক্তির এক পবিত্র মিলন, যা আমাদের নিজেদের বৃহত্তর উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্ম করে।

















