ব্যুরো নিউজ ৪ জুন : উচ্চ মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের প্রায় এক মাস পর অবশেষে স্নাতকস্তরে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরুর দিনক্ষণ নিয়ে জট কাটল। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু মঙ্গলবার জানিয়েছেন, আগামী মঙ্গলবারের মধ্যেই কলেজ ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হবে এবং গত বছরের তুলনায় এবার ভর্তি প্রক্রিয়া আগে শুরু হবে। তবে, এই ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই রাজ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে চলমান একাধিক বিতর্ক, বিশেষত শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং ওবিসি সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইনি জটিলতা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস: দ্রুত খুলছে ভর্তির পোর্টাল
গত ৪ মে, ২০২৫ তারিখে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশ হলেও, প্রায় এক মাস ধরে স্নাতকস্তরে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট বিজ্ঞপ্তি না আসায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছিল। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আশ্বস্ত করে জানান, আগামী মঙ্গলবার অর্থাৎ ১০ জুন, ২০২৫-এর মধ্যেই ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এবার ভর্তির প্রক্রিয়ায় কোনো বিলম্ব হয়নি। গত বছর ১৯ জুন ভর্তির পোর্টাল খোলা হয়েছিল, এবার তার আগেই প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। এটি সিঙ্গেল সেন্ট্রালাইজড অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যেখানে একজন শিক্ষার্থী সর্বাধিক ২৫টি আবেদন করতে পারবেন।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
ওবিসি সংরক্ষণ ও আইনি জটিলতা: ভর্তির পেছনের কারণ
কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ওবিসি (OBC) সংরক্ষণ নিয়ে চলা আইনি জটিলতা। কলকাতা হাইকোর্ট সম্প্রতি ২০১০ সালের পর জারি হওয়া কিছু ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করায় একটি বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল। এই রায়ের জেরে ভর্তির প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে আটকে গিয়েছিল, কারণ নতুন নীতি এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত না করে ভর্তি শুরু করা সম্ভব ছিল না। যদিও সম্প্রতি এই জট সাময়িকভাবে কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছে, তবে এই সংক্রান্ত বিলটি বিধানসভায় পেশ এবং পাস হওয়ার পরই পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এই আইনি জট কাটাতে না পারলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি কোটায় ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকত।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির আবছায়া: শিক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রভাব
কলেজ ভর্তির এই প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি (Teacher Recruitment Scam) এক বিশাল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এসএসসি (SSC) ২০১৬-র চাকরিহারাদের লাগাতার আন্দোলন-বিক্ষোভে রাজ্যের শিক্ষা পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছে, যার মধ্যে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি-র কর্মীরাও রয়েছেন। অনেক স্কুলেই শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা কমেছে, যা পঠন-পাঠনের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সম্প্রতি, স্কুল সার্ভিস কমিশন ২০১৬ সালের চাকরিহারাদের নিয়োগের পরীক্ষার নতুন বিধি প্রকাশ করেছে, যেখানে নম্বর সংক্রান্ত কিছু বদল ও বিভাজন আনা হয়েছে। তবে, এই নতুন বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ করে মঙ্গলবারই কলকাতা হাইকোর্টে আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। যোগ্য চাকরিহারাদের নতুন করে পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তার রেশ এখনও কাটেনি। মামলাকারীদের অভিযোগ, নতুন নিয়োগ বিধি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপন্থী এবং এটি আদালত অবমাননার সামিল। তাদের দাবি, ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিধি সেই বছরের মতোই করতে হবে, অন্যথায় ২০১৬ সালের চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হবেন। বয়সের ছাড় এবং অভিজ্ঞতার নম্বর বিভাজন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) বিরুদ্ধে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। ইডি (ED) এবং সিবিআই (CBI)-এর তদন্তে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। এই দুর্নীতির ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে, যা উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রেও পরোক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষক স্বল্পতা এবং নিয়োগ পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিয়ে চলমান বিতর্ক ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
সার্বিক প্রেক্ষাপট
যদিও শিক্ষামন্ত্রী কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন এবং একটি অভিন্ন কেন্দ্রীয় অনলাইন পোর্টালে (WBCAP) মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে বলে জানানো হয়েছে, তবে ওবিসি সংরক্ষণ এবং শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির আইনি ও সামাজিক জটিলতা এই ভর্তি প্রক্রিয়ার উপর একটি ছায়া ফেলছে। রাজ্য সরকার আশা করছে, এই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে, কিন্তু চলমান বিতর্কগুলি শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক সুস্থতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তৈরি করছে।