ব্যুরো নিউজ ৫ আগস্ট ২০২৫ : ‘অঞ্জনা নন্দনং বীরং জানকী শোক নাশনম্। কপীশমক্ষহন্তারং বন্দে লঙ্কভয়ঙ্করম্॥’
দেবতা, ঋষি এবং কিংবদন্তি সত্তাদের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি ‘চিরঞ্জীবী’ উপাধি লাভ করেছেন, যারা পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকবেন বলে বিশ্বাস করা হয়। হনুমান, পবনদেবতা বায়ুর পুত্র, এই অমর সত্তাদের মধ্যে প্রধান। যেখানে অন্যান্য দেবতারা তাঁদের স্বর্গীয় রাজ্যে বাস করেন এবং মানুষ তাঁদের কর্মচক্রে আসে-যায়, সেখানে হনুমানকে আমাদের মাঝে অদৃশ্য কিন্তু সর্বদা সতর্ক, জাগ্রত এবং স্বাধীনভাবে বিচরণকারী বলে মনে করা হয়।
তাহলে, কী কারণে হনুমান এই অমর মর্যাদা পেলেন? কেন তিনি ধর্মরক্ষাকারী, অভিভাবক এবং চিরন্তন সেবক হিসাবে পূজিত হন? এটি বোঝার জন্য তাঁর অমরত্বের পেছনের আধ্যাত্মিক, প্রতীকী এবং মহাজাগতিক সত্যগুলি গভীরভাবে জানতে হবে। হনুমানের এই অবিনশ্বর উপস্থিতি শুধুমাত্র একটি আশীর্বাদ নয়, বরং একটি জীবন্ত আদর্শ যা কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
কেন হনুমান চিরঞ্জীবী?
১. ভগবান রামের অমরত্বের বর
প্রাচীন গ্রন্থ এবং কিংবদন্তি অনুসারে, লঙ্কার যুদ্ধের পর ভগবান রাম হনুমানকে একটি বিশেষ বর দিয়েছিলেন। হনুমানের অবিচল ভক্তি, নম্রতা এবং রামের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে রাম ঘোষণা করেছিলেন যে, যতদিন রামের নাম উচ্চারিত হবে, ততদিন হনুমান পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন। যেহেতু রামের গাথা চিরন্তন এবং প্রতিটি যুগে তা গাওয়া হবে, তাই যেখানেই রামের প্রতি ভালোবাসা থাকবে, সেখানেই হনুমানের উপস্থিতি থাকবে।
২. সেবার চিরন্তন প্রতীক
হনুমানের অমরত্ব কোনো রাজ্য বা ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং নিঃস্বার্থ সেবার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি কখনও রাজ্য বা সম্পদ চাননি। তাঁর একমাত্র ইচ্ছা ছিল চিরকাল রামের সেবা করা। এই বিশুদ্ধ এবং নিঃস্বার্থ ‘সেবা’র মনোভাবই হনুমানকে ভালোবাসাময় সেবার চিরন্তন প্রতীক করে তুলেছে। এটি এমন একটি গুণ যা কখনও মরে না, তাই যিনি এই গুণের প্রতীক, তিনিও অমর থেকে যান এবং প্রজন্মকে নম্রতা ও নিষ্ঠার সাথে সেবা করতে অনুপ্রাণিত করেন।
Hanumanji : রহস্যময় পঞ্চমুখী হনুমান: এক অলৌকিক রূপের মহাজাগতিক শক্তি
৩. সকল দেবতার আশীর্বাদ
হনুমানের অমরত্ব বিভিন্ন দেবতার কাছ থেকে পাওয়া আশীর্বাদ দ্বারা আরও শক্তিশালী হয়েছে। শিশুকালে ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পরও তিনি শুধু বেঁচে যাননি, বরং স্বর্গীয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাও লাভ করেন। অগ্নিদেব তাঁকে আগুন থেকে সুরক্ষা দেন। বরুণদেব তাঁকে জল থেকে রক্ষা করেন এবং তাঁর পিতা বায়ুদেব তাঁকে সীমাহীন শক্তি দান করেন। এই আশীর্বাদগুলি হনুমানের শারীরিক কাঠামোকে অবিনশ্বর করে তোলে, যা তাঁকে চিরকাল পৃথিবীতে থাকার জন্য যোগ্য করে তোলে।
৪. কলিযুগের রক্ষক
প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে, কলিযুগে, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক অধঃপতনের যুগে, মহাজাগতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সাতটি সত্তাকে চিরকাল জীবিত রাখার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। হনুমানের ভূমিকা হলো ভক্তির আলো যেন ম্লান না হয় তা নিশ্চিত করা। ভক্তিযোগের রক্ষক হিসেবে তিনি প্রকৃত সাধকদের অভ্যন্তরীণ অন্ধকার এবং বাধা দূর করতে সাহায্য করেন। যখনই ধর্ম বিপদের মুখে পড়ে, তখন হনুমানকে অদৃশ্যভাবে আবির্ভূত হতে দেখা যায়, যেখানে তাঁকে ডাকা হয়, সেখানেই তিনি সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকেন।
৫. হনুমান: জীবন্ত প্রাণশক্তি
আরও গভীর স্তরে, হনুমান ‘প্রাণ’-এর অর্থাৎ জীবনশক্তির প্রতীক। তাঁর পিতা বায়ু হলেন বাতাসের দেবতা, যা সমস্ত জীবের শ্বাস। যোগিক শিক্ষায় বলা হয় যে শ্বাসই শরীরকে আত্মার সাথে সংযুক্ত করে। এই অর্থে, হনুমানের অমরত্ব কেবল শারীরিক নয়; এটি অবিনশ্বর জীবনশক্তির প্রতীক যা সমস্ত জীবিত সত্তার মধ্যে প্রবাহিত হয়। যতদিন শ্বাস আছে, ততদিন হনুমানও আছেন, জীবনকে টিকিয়ে রাখা সূক্ষ্ম শক্তিতে তিনি সর্বদা উপস্থিত।
৬. অন্তহীন সাহস ও শক্তি
হনুমানের চিরন্তন উপস্থিতি এই সত্যের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সাহস এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি কখনও ধ্বংস হতে পারে না। ভক্তরা তাঁকে ভয়, বাধা এবং নেতিবাচকতা দূর করার জন্য আহ্বান জানান। হনুমান চালিসা পাঠ করলে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাঁর অমরত্ব হলো এই জীবন্ত সত্য যে, ঐশ্বরিক শক্তি প্রতিটি আন্তরিক হৃদয়ের মধ্যে থাকে এবং সময় বা প্রতিকূলতা তাকে পরাজিত করতে পারে না।
৭. যুগে যুগে গল্প এবং দর্শন
সাধু-সন্ত এবং আন্তরিক ভক্তদের কাছে হনুমানের আবির্ভাবের অসংখ্য গল্প প্রচলিত আছে, এমনকি আধুনিক যুগেও। তুলসীদাস, যিনি রামচরিতমানস লেখার সময় হনুমানের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করেন, থেকে শুরু করে আধুনিক ঋষিরা যারা তাঁর আশীর্বাদের গল্প শোনান, এই সমস্ত কাহিনীগুলি এই বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করে যে পৃথিবীতে থাকার হনুমানের শপথ কেবল একটি প্রাচীন কিংবদন্তি নয়, বরং যারা তাঁকে সত্য বিশ্বাসে আহ্বান করে, তাঁদের জন্য এটি একটি জীবন্ত বাস্তবতা।
৮. মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে সেতু
অন্যান্য দেবতারা যখন দূরবর্তী স্বর্গীয় রাজ্যে থাকেন, তখন হনুমান মানুষের কাছাকাছি থেকে মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে সেতু স্থাপন করেন। তাঁর অমরত্ব ভক্তদের আশ্বাস দেয় যে আন্তরিক প্রার্থনা সর্বদা তাঁর কাছে পৌঁছাবে। তিনিই সেই সহজে-পৌঁছানো রক্ষক যিনি দুঃখে থাকা মানুষের কথা শোনেন, দুর্বলদের রক্ষা করেন এবং শক্তিহীনদের শক্তি দেন। তাঁর চিরন্তন উপস্থিতি তাঁকে সাধারণ জগৎ এবং আধ্যাত্মিক রাজ্যের মধ্যে এক জীবন্ত সংযোগ করে তুলেছে।
Hanumanji West Bengal : পশ্চিমবাংলায় বজরংবলী পূজার উৎস ও ইতিহাস: একটি বিশদ প্রতিবেদন
আমাদের মধ্যেকার অমরত্ব
যখন মানুষ হনুমানকে চিরঞ্জীবী হিসেবে উল্লেখ করে, তখন এটি কেবল কোনো জঙ্গলে বা পবিত্র স্থানে লুকিয়ে থাকা এক পরাক্রমশালী বানর সম্পর্কে নয়। এটি এই সত্যের এক স্মরণ যে ভক্তি, সেবা, সাহস এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মতো গুণগুলি সত্যিই অমর। সময়, ধ্বংস এবং মৃত্যু এগুলিকে স্পর্শ করতে পারে না। এই অর্থে, হনুমান আমাদের প্রতিটি শ্বাসে, হৃদস্পন্দনে, এবং প্রতিটি দয়া বা বিশ্বাসের কাজে জীবিত। যখনই তাঁর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখনই তিনি যে শক্তির প্রতীক, তা সজাগ হয়ে ওঠে।
সুতরাং, যখন আপনি হনুমান চালিসা পাঠ করেন বা ‘জয় বজরংবলী!’ উচ্চারণ করেন, তখন মনে রাখবেন আপনি এমন এক শক্তিকে আহ্বান করছেন যা কখনও ম্লান হয় না, এক আত্মাকে আহ্বান করছেন যা কখনও ঘুমায় না, এবং এমন এক বন্ধুকে আহ্বান করছেন যে কখনও আপনার পাশ ছেড়ে যায় না। যে পৃথিবীতে সর্বদা পরিবর্তনশীল, সেখানে হনুমান একজন অপরিবর্তনীয় রক্ষক, নির্ভীক অভিভাবক এবং ভালোবাসার জীবন্ত প্রমাণ যা সত্যিই কোনও শেষ জানে না।
“রামদূত অতুলিত বলধামা, অঞ্জনি পুত্র পবনসুত নামা।”
হনুমানের অমর আত্মা আপনাকে সর্বদা পথ দেখাক এবং শক্তি দিক।



















