ব্যুরো নিউজ ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ : কলকাতা হাইকোর্টে ৩২ হাজার অপ্রশিক্ষিত প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল মামলার শুনানি আবারও রাজ্যের শিক্ষা মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর এজলাসে এই মামলার শুনানি হয়, যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। এই মামলাটি এখন চাকরিপ্রার্থী এবং কর্মরত শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
শুনানির মূল বিষয়বস্তু
এদিনের শুনানিতে মামলাকারীদের পক্ষে আইনজীবী সৌম্য মজুমদার এবং বিকাশ ভট্টাচার্য একাধিক জোরালো সওয়াল করেন। তাদের প্রধান অভিযোগগুলি ছিল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, নিয়ম লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি। শুনানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো:
- ব্রেকআপ মার্কস প্রকাশে অসঙ্গতি: মামলাকারীদের আইনজীবী জানান, আদালত ২০১৭ এবং ২০২১ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের ব্রেকআপ মার্কস প্রকাশের নির্দেশ দিলেও, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ প্রকাশিত মার্কস শিটে একাধিক ভুল ছিল। এই ভুল সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পূরণ করা হয়নি।
- অ্যাপটিটিউড টেস্টে নির্দেশিকার অভাব: অভিযোগ করা হয় যে, ২০১৭ সালের নিয়োগে অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়ার জন্য ইন্টারভিউয়ারদের কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়নি, যা ২০২১ সালের নিয়োগে ছিল। এটি পুরো প্রক্রিয়াটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
- মেধা তালিকার অভাব: প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ কখনো ক্যাটেগরি অনুযায়ী ব্রেকআপ মার্কসসহ সম্পূর্ণ মেধা তালিকা প্রকাশ করেনি, যা স্বচ্ছতার অভাবকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
- দুর্নীতির অভিযোগ: আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি শুরু থেকেই একটি “প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি” (institutional fraud) ছিল। ওএমআর (OMR) শিট মূল্যায়নের জন্য কোনো টেন্ডার ছাড়াই একটি বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়, যা নিয়মের পরিপন্থী।
SSC Recruitment scam : শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়াল তৃণমূলের আরেক মন্ত্রীর নাম , রাজ্যপাল দিলেন তদন্তের অনুমোদন
আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং রাজ্যের উদ্বেগ
শুনানি চলাকালীন বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যদি ৩২ হাজার কর্মরত শিক্ষককে বরখাস্ত করে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বলা হয়, সেই পরিস্থিতি কি রাজ্য সরকার সামাল দিতে পারবে? তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, কয়েক দশক আগে মাধ্যমিক পাস করা প্রার্থীদের এবং বর্তমান প্রার্থীদের একই প্ল্যাটফর্মে মূল্যায়ন করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর সাথে বিচারপতি, প্যানেল বাতিলের পরে রাজ্য সরকার দ্রুত ও সঠিকভাবে আবার পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ করতে পারবে কিনা, সেই নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন।
বিজেপি নেতা অর্জুন সিংয়ের বিতর্কিত মন্তব্য
টেট এবং এসএসসি চাকরি দুর্নীতি প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা অর্জুন সিং সম্প্রতি নেপালের ন্যায় গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এর ফলস্বরূপ তার নামে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে একটি এফআইআর (FIR) দায়ের করা হয়েছে।
এফআইআর দায়েরের পর অর্জুন সিং তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “নেপালে বাংলার মাত্র ১০% দুর্নীতি ঘটেছে, তাতেই সেখানকার যুব সমাজ রাস্তায় নেমে গণঅভ্যুত্থান করলো, সরকার পাল্টে দিল।” তিনি আরও বলেন, “বাংলায় বাংলার মেয়েকে চাই বলে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় এলেন আর বাংলার মেয়েরা খুন হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে বলে একটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, কিছু ডাক্তাররা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।”
তিনি বেকারত্ব ও দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলেন, “নেপাল যেটা বুঝতে পেরেছে, বেকারত্ব এবং দুর্নীতির জ্বালা, সেটা এখানেও ঘটছে। চাকরি নেই, দেড় কোটির ওপর পরিযায়ী শ্রমিক বঙ্গে, কত দিন সহ্য করবে বাংলার যুব সমাজ? তাকে যদি জাগরণের জন্য কোনো কথা বলে থাকি, কিছু ভুল বলিনি।”
তৃণমূল কংগ্রেস নেতা পার্থ ভৌমিকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আমার নামে মাত্র একটা এফআইআর করেছে এই ব্যাপারে। পার্থ ভৌমিককে চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আপনি ৪০০ এফআইআর করুন আমার বিরুদ্ধে, আমার কিছু যাবে আসবে না। অন্তত ৪০০টা কমপ্লেন না করলে আমার মান সম্মান থাকবে না। এই রকম দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। এই ধরনের সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থান সংবিধান বিরোধী নয়।”
মামলার ভবিষ্যৎ
এই মামলার পরবর্তী শুনানি ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এ অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে বিকাশ ভট্টাচার্য তার সওয়াল চালিয়ে যাবেন। ৩২ হাজার শিক্ষকের ভবিষ্যৎ এখন আদালতের রায়ের ওপর নির্ভরশীল। একদিকে যেমন কর্মরত শিক্ষকদের চাকরি হারানোর ভয়, তেমনই অন্যদিকে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায়বিচারের আশা। এই মামলাটি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। আগামী দিনে আদালত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, সেদিকেই তাকিয়ে থাকবে গোটা রাজ্য।