ব্যুরো নিউজ ৯ জুন : তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি এবং তাইওয়ানের আকাশসীমা বারবার লঙ্ঘনের ঘটনা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। একদিকে তাইওয়ান নিজেকে একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে, অন্যদিকে চীন এটিকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সংযুক্ত করার হুমকি দিয়ে থাকে। এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং কোস্ট গার্ড চীনা সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর প্রতিটি গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
তাইওয়ান-চীন সংঘাতের ঐতিহাসিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট:
তাইওয়ান এবং চীনের মধ্যে সংঘাতের শিকড় ১৯৪৯ সালের চীনা গৃহযুদ্ধের গভীরে নিহিত। মাও সেতুংয়ের কমিউনিস্ট বাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর চিয়াং কাই-শেক-এর নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী কুওমিনতাং সরকার মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ানে পালিয়ে যায় এবং সেখানেই ‘রিপাবলিক অফ চায়না’ (ROC) প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে, মূল ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টি ‘পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না’ (PRC) গঠন করে। উভয় পক্ষই তখন থেকে নিজেদেরকে ‘এক চীন’-এর একমাত্র বৈধ সরকার হিসেবে দাবি করে আসছে।
চীন ‘এক চীন নীতি’ (One-China Principle) মেনে চলে, যা অনুসারে বিশ্বে কেবল একটিই চীন আছে এবং তাইওয়ান তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেজিং তাইওয়ানকে তাদের একটি বিদ্রোহী প্রদেশ হিসেবে দেখে এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটিকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে। প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সাথে একত্রিত করার অধিকার চীন সংরক্ষণ করে। অন্যদিকে, তাইওয়ান তার নিজস্ব নির্বাচিত সরকার, সংবিধান, সামরিক বাহিনী, পাসপোর্ট এবং মুদ্রা নিয়ে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যা এর বাস্তব স্বাধীনতার ইঙ্গিত দেয়। যদিও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ চীনের কূটনৈতিক চাপের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, তবে তারা তাইওয়ানের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখে। যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতি’ মেনে চললেও, তাইওয়ানের আত্মরক্ষার জন্য সামরিক সহায়তা প্রদান করে থাকে, যা চীনের কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। তাইওয়ানের ভৌগোলিক অবস্থানও অত্যন্ত কৌশলগত, যা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের ক্ষমতা বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
তাইওয়ানের চারপাশে চীনের আগ্রাসী তৎপরতা:
তাইওয়ানের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (MND) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানের আঞ্চলিক জলসীমা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা সনাক্তকরণ অঞ্চল (ADIZ) এর কাছাকাছি চীনা সামরিক বিমান ও নৌযানের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
সোমবার (৯ই জুন, ২০২৫) সকাল ৬টা (স্থানীয় সময়) পর্যন্ত, তাইওয়ানের MND ৭টি চীনা বিমান এবং ৮টি চীনা নৌবাহিনীর জাহাজ শনাক্ত করেছে। এই ৭টি উড়ানের মধ্যে ৫টি মিডিয়ান লাইন (তাইওয়ান প্রণালীতে একটি অনানুষ্ঠানিক বিভাজন রেখা) অতিক্রম করে তাইওয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলীয় এডিআইজেড-এ প্রবেশ করে। তাইওয়ানের সশস্ত্র বাহিনী পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।এর আগে রবিবার, তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১১টি চীনা বিমানের উড়ান (যার মধ্যে ৬টি দক্ষিণ-পশ্চিম এডিআইজেড-এ প্রবেশ করেছিল) এবং ৭টি চীনা নৌবাহিনীর জাহাজ শনাক্তের খবর জানিয়েছিল।
কিউমেন উপকূলে চীনা কোস্ট গার্ডের অনুপ্রবেশ:
তাইওয়ান প্রণালীর কিউমেন দ্বীপপুঞ্জের কাছেও চীনের আগ্রাসী কার্যকলাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাইওয়ানের কোস্ট গার্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (CGA) বুধবার ঘোষণা করেছে যে তারা চীনা কোস্ট গার্ডের চারটি জাহাজকে “বহিষ্কার” করেছে, যারা তাইওয়ান-নিয়ন্ত্রিত জলে প্রবেশ করেছিল। চীনা কোস্ট গার্ডের জাহাজ 14603, 14608, 14609, এবং 14513 কিউমেন দ্বীপপুঞ্জের “সীমাবদ্ধ জলের” দিকে এগিয়ে আসে।
এটি প্রথমবার নয়; মঙ্গলবারও একই চারটি চীনা জাহাজ তাইওয়ান-নিয়ন্ত্রিত জলে প্রবেশ করে এবং দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অবস্থান করার পর তাইওয়ানের কোস্ট গার্ডের পর্যবেক্ষণে চলে যায়।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব:
তাইওয়ানের চারপাশে চীনের এই বর্ধিত সামরিক কার্যকলাপ তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই পদক্ষেপগুলি তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বের প্রতি চীনের চ্যালেঞ্জ এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং অনেক দেশ তাইওয়ানের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সমর্থন জানাচ্ছে। তবে, চীন তার দাবি থেকে সরে আসার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না, যা এই ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলছে।