সৌরভ রায় চৌধুরী , ১৩ জুলাই ২০২৫ : পুরী, যা জগন্নাথ ধাম নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিত, ভারতের এক পবিত্র তীর্থভূমি। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, ওড়িশার সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র, যা লক্ষ লক্ষ ভক্তের কাছে গভীর তাৎপর্য বহন করে। ১১৪৬ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে তা সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে, পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের রাজা তৃতীয় অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গ দেব তাঁর রাজ্যকে জগন্নাথের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে ঘোষণা করেন যে, তিনি এবং তাঁর বংশধররা “জগন্নাথের পুত্র ও সামন্ত” হিসেবে ঐশ্বরিক আদেশে শাসন করবেন। এটি নিছক একটি ধর্মীয় ঘোষণা ছিল না, বরং এক গভীর রাজনৈতিক কৌশল ছিল। এর মাধ্যমে মন্দিরটি রাজ্যের সার্বভৌমত্বের প্রতীকে পরিণত হয়, যা আক্রমণকারীদের কাছে কেবল উপাসনালয় নয়, রাজ্যের মূল ভিত্তি এবং জনগণের সম্মিলিত পরিচিতির উপর আঘাত হানার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাস অত্যন্ত ঘটনাবহুল, যেখানে ৭ম শতাব্দী থেকে ১৯শ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত মোট ১৮ বার আক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত রয়েছে। যদিও প্রাথমিক আক্রমণগুলির মধ্যে রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দ (৭৯৮-৮১৪ খ্রিস্টাব্দ) এর মতো হিন্দু শাসকদের আক্রমণও অন্তর্ভুক্ত ছিল, মুসলিম শাসকদের আগমনের সাথে সাথে আক্রমণের প্রকৃতি ও তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়, বিশেষত যারা মোগল সাম্রাজ্য বা এর আঞ্চলিক সহযোগীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই প্রতিবেদনটি বিশেষভাবে আলোচনা করবে কীভাবে মোগল যুগে পুরীধাম এবং এর ঐতিহ্যবাহী মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতে সরাসরি মোগল বাহিনী, তাদের নিযুক্ত সুবেদার (শাসক) এবং মোগল প্রভাবাধীন আঞ্চলিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত আক্রমণগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই আক্রমণগুলি স্বতন্ত্র ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ও বিঘ্ন ঘটিয়েছিল, যা মন্দিরের সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং সময় চিহ্নিত করে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, পুরীর উপর আক্রমণগুলি কেবল ধনসম্পদ লুঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এর একটি গভীরতর উদ্দেশ্য ছিল। প্রাথমিক তথ্য ইঙ্গিত করে যে আক্রমণগুলি মূলত “সম্পদ লুঠের” উদ্দেশ্যে হয়েছিল, ধর্মীয় কারণে নয়। তবে, পরবর্তী সূত্রগুলিতে “জিহাদ” (ধর্মীয় যুদ্ধ), “অপবিত্র প্রতিমা” এবং ধ্বংসের সুস্পষ্ট আদেশের (যেমন আওরঙ্গজেব কর্তৃক) উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে পরবর্তী মুসলিম আক্রমণগুলিতে, বিশেষ করে মোগল প্রভাবাধীন সময়ে, একটি বিবর্তন বা দ্বৈত উদ্দেশ্য বিদ্যমান ছিল। নিছক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে (যদিও তা তখনও বিদ্যমান ছিল) আরও স্পষ্ট ধর্মীয় প্রতিমা-ধ্বংসের (প্রতিমা ভাঙা, অপবিত্রকরণ) দিকে এই পরিবর্তনটি বস্তুগত ক্ষতির বাইরেও এক গভীরতর আঘাতের ইঙ্গিত দেয়, যা সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক কাঠামোকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছিল।
মোগল-যুগের আক্রমণের নেপথ্যের কারণ
পুরীধামের উপর মোগল-যুগের আক্রমণগুলি একাধিক জটিল উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়েছিল, যা কেবল সামরিক বিজয় বা অর্থনৈতিক লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না:
পুরীর কৌশলগত গুরুত্ব এবং বিপুল সম্পদ
পুরীর উপকূলীয় অবস্থান এটিকে বাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণ এবং আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। জগন্নাথ মন্দির শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজকীয় অনুদান এবং তীর্থযাত্রীদের উৎসর্গের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করেছিল। এটি আক্রমণকারীদের জন্য “সম্পদ লুঠের একটি অত্যন্ত লাভজনক স্থান” ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে মীর ফতেহ খান মন্দির আক্রমণ করেছিলেন বিশেষভাবে “হীরা, মুক্তা এবং সোনা সহ মূল্যবান রত্ন” লুঠ করার উদ্দেশ্যে।
রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা
মোগল সাম্রাজ্য তার সাম্রাজ্যবাদী নীতির জন্য পরিচিত ছিল এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার মধ্যে ওড়িশাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে চেয়েছিল। পুরী এবং এর শ্রদ্ধেয় মন্দির নিয়ন্ত্রণ করা ছিল মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় হিন্দু শাসকদের বশীভূত করার একটি উপায়। ১৫৬৮ সালের আক্রমণের পর, ওড়িশা বাংলার সুলতানদের প্রভাবে আসে এবং পরবর্তীতে মোগলদের অধীনে আসে। হাসিম খান, কল্যাণ মল্ল, মুকাররম খান এবং আহমদ বেগ-এর মতো মোগল সুবেদার ও গভর্নরদের নিয়োগ সরাসরি পুরীর উপর আক্রমণের দিকে পরিচালিত করে, যা তাদের ক্ষমতা সুসংহত করার প্রশাসনিক ও সামরিক অভিযানের অংশ ছিল।
ধর্মীয় প্রতিমা-ধ্বংস এবং “জিহাদ” প্রদর্শন
অনেক অ-হিন্দু আক্রমণকারীর কাছে মন্দিরটি “জিহাদ (ধর্মীয় যুদ্ধ) প্রদর্শনের” এবং “প্রতিমা অপবিত্র করার” একটি স্থান হিসাবেও বিবেচিত হত। এই উদ্দেশ্যটি বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের মতো গোঁড়া সম্রাটদের শাসনামলে প্রাধান্য লাভ করে, যিনি আকবরের মতো পূর্বসূরিদের তুলনামূলকভাবে সহনশীল নীতি পরিবর্তন করেন এবং “ধর্মীয় গোঁড়ামির” ভিত্তিতে হিন্দু মন্দিরগুলির বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক অভিযান শুরু করেন। আওরঙ্গজেব ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে “জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ জারি করেন”। ওড়িশায় নিযুক্ত তার গভর্নররা এই নির্দেশ কার্যকর করার চেষ্টা করেন। কুখ্যাত কালাপাহাড়, একজন আফগান সেনাপতি, “প্রতিমা-ধ্বংসকারী এবং বুতশেকান (প্রতিমা ভাঙার বিশেষজ্ঞ)” হিসাবে পরিচিত ছিলেন, যার ১৫৬৮ সালের আক্রমণ “বিশেষত পুরীর মতো স্থানগুলিতে অত্যন্ত বিধ্বংসী” ছিল।
আক্রমণগুলির উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মোগল-যুগের আক্রমণগুলি কদাচিৎ একক উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়েছিল। বরং, অর্থনৈতিক লাভ রাজনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য সম্পদ সরবরাহ করত, যখন ধর্মীয় ন্যায্যতা (জিহাদ, প্রতিমা-ধ্বংস) বিজিত জনগোষ্ঠীর মনোবল ভাঙতে এবং তাদের সাংস্কৃতিক প্রতীকগুলির ধ্বংসকে বৈধতা দিতে ব্যবহৃত হত। এই বহুমুখী উদ্দেশ্য ক্ষতির এক ব্যাপকতর ও বিধ্বংসী রূপের জন্ম দেয়, যা কেবল সম্পদ নয়, বরং সমাজের আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকেও লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছিল।
“মোগল-যুগের” আক্রমণের সংজ্ঞা
যদিও কিছু প্রাথমিক মুসলিম আক্রমণ ওড়িশায় সরাসরি মোগল শাসনের আগে ঘটেছিল (যেমন ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ, ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ তুঘলক, ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে ইসমাইল গাজী), ১৬শ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে শুরু করে এই অঞ্চলে মোগল সাম্রাজ্যের সরাসরি কমান্ডের অধীনে থাকা বাহিনী বা আঞ্চলিক শক্তিগুলির (যেমন বাংলার আফগান সুলতানরা) দ্বারা আক্রমণ দেখা যায়, যাদের কার্যকলাপ ওড়িশা সম্পূর্ণরূপে মোগল আধিপত্যের অধীনে আসার আগে অঞ্চলটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছিল। গুরুত্বপূর্ণভাবে, ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আকবর যখন মান সিংকে ওড়িশায় পাঠান, তখন প্রদেশটি “মোগল প্রভাবের” অধীনে আসে, যার ফলে পরবর্তীতে মোগল সুবেদার ও কমান্ডারদের দ্বারা আক্রমণ পরিচালিত হয়।
আওরঙ্গজেবের শাসনামল মন্দিরের উপর আক্রমণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় চিহ্নিত করে। যদিও পূর্ববর্তী আক্রমণগুলিতে লুঠপাট এবং কিছু অপবিত্রকরণ জড়িত ছিল, ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব “জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ জারি করেন”। এটি পূর্ববর্তী, আরও সুযোগসন্ধানী লুঠপাটের চেয়ে একটি পদ্ধতিগত, রাষ্ট্র-অনুমোদিত ধ্বংসের দিকে নীতিগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যা ধর্মীয় গোঁড়ামির মূলে নিহিত ছিল। এটি পুরীধামের ক্ষতির ইতিহাসে তাঁর শাসনকালকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে, কারণ এটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিলুপ্তির একটি ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা ছিল, কেবল বিজয়ের আনুষঙ্গিক ক্ষতি নয়।
রথযাত্রার গৌরবময় ইতিহাস: ভারতীয় সংস্কৃতির চাকা ঘোরে যেখান থেকে
মোগল-যুগের নির্দিষ্ট আক্রমণ ও তাদের ধ্বংসযজ্ঞ
এই অংশটি মোগল যুগে পুরীধাম ও জগন্নাথ মন্দিরের উপর সংঘটিত নির্দিষ্ট ক্ষতির ঘটনাগুলি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে, ধ্বংস, লুঠপাট, অপবিত্রকরণ এবং রীতিনীতির বিঘ্নিত হওয়ার প্রকৃতি তুলে ধরে।
কালাপাহাড়ের আক্রমণ (১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দ)
- আক্রমণকারী: কালাপাহাড়, বাংলার আফগান সুলতান সুলাইমান কররানীর একজন সেনাপতি। যদিও সরাসরি মোগল নন, তাঁর আক্রমণ ওড়িশায় হিন্দু শাসনের অবসান ঘটায় এবং একটি বিধ্বংসী নজির স্থাপন করে যা পরবর্তী মোগল-যুগের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করেছিল।
- ক্ষতির প্রকৃতি: এটি ছিল “এ যাবৎকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী” আক্রমণ।
- প্রতিমা অপবিত্রকরণ ও ধ্বংস: কালাপাহাড় চিলিকা হ্রদের গোপন স্থান থেকে প্রতিমাগুলি নিয়ে আসেন, হাতির পিঠে করে গঙ্গা নদীর তীরে নিয়ে যান এবং “পুড়িয়ে ফেলেন”। মাদলা পঞ্জি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে যে তিনি প্রতিমা পোড়ানোর চেষ্টা করেন এবং তারপর “পবিত্র বস্তু (দারু ব্রহ্ম) ধারণকারী অর্ধ-পোড়া প্রতিমা” গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন।
- মন্দির লুঠ ও ধ্বংস: তিনি “জগন্নাথ মন্দিরের ধনসম্পদ লুঠ করেন, মন্দিরের প্রতিটি প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত করেন, পবিত্র কল্পবৃক্ষ উপড়ে ফেলেন এবং পুড়িয়ে ফেলেন”।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: এই আক্রমণের কারণে ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৯ বছর ধরে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়নি।
- প্রেক্ষাপট: কালাপাহাড়ের কার্যকলাপ, ব্যক্তিগত বিদ্রোহ বা আফগান সুলতানী নীতির দ্বারা চালিত হোক না কেন, তীব্র প্রতিমা-ধ্বংসের একটি ধারা স্থাপন করে যা পরবর্তী মোগল-যুগের আক্রমণগুলিতে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।
প্রাথমিক মোগল-যুগের আক্রমণ (১৬শ শতাব্দীর শেষভাগ – ১৭শ শতাব্দীর প্রথমভাগ)
- সুলাইমান (১৫৯২ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: সুলাইমান, কুতু খানের পুত্র, এবং উসমান, ইশার পুত্র (ওড়িশার শাসক)।
- ক্ষতির প্রকৃতি: পুরীর বহু লোক “গণহারে নিহত” হয়, মন্দির আক্রান্ত হয় এবং “অনেক প্রতিমা ভাঙা হয়”।
- মির্জা খুররম (১৬০১ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: বাংলার নবাব ইসলাম খানের সেনাপতি।
- আক্রমণের প্রকৃতি: শ্রীমন্দির আক্রমণ করেন।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: এক বছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়নি।
- হাসিম খান (১৬০৭/১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: ওড়িশার সুবেদার।
- আক্রমণের প্রকৃতি: পুরী ও শ্রীমন্দির আক্রমণ করেন।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: এক বছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়নি।
- কেশোদাশমারু (১৬১০ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: হাসিম খানের অধীনে কর্মরত একজন হিন্দু রাজপুত জায়গিরদার।
- ক্ষতির প্রকৃতি: মন্দিরের প্রাঙ্গণ দখল করেন এবং রথযাত্রা উৎসবের সময় “জগন্নাথ পুরীর রথগুলিতে আগুন লাগানোর” কুখ্যাতি অর্জন করেন।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: রথ জ্বালিয়ে সরাসরি রথযাত্রায় বিঘ্ন ঘটান। প্রতিমা অপবিত্রকরণ এবং মন্দির ধ্বংস ধর্মীয় প্রতীকগুলির উপর সরাসরি আক্রমণ হলেও, কেশোদাশমারু কর্তৃক রথযাত্রার রথগুলিতে আগুন লাগানোর ঘটনা ক্ষতির একটি গভীরতর স্তরকে নির্দেশ করে। রথযাত্রা কেবল একটি আচার নয়; এটি ভক্তির একটি জনসমক্ষে প্রদর্শন এবং পুরীর আধ্যাত্মিক জীবনকে সংজ্ঞায়িতকারী একটি কেন্দ্রীয় বার্ষিক ঘটনা। রথগুলিকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ক্যালেন্ডার এবং জনসমক্ষে ধর্মীয় প্রকাশের মূল কাঠামোকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে ছিল, যা শারীরিক ধ্বংসের বাইরেও ব্যাপক মানসিক ও সাম্প্রদায়িক দুর্দশার কারণ হয়েছিল।
- কল্যাণমল্ল (১৬১১, ১৬১২, ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: রাজা টোডর মল্লের পুত্র, ওড়িশার সুবেদার।
- আক্রমণের প্রকৃতি: শ্রীমন্দিরে “বর্বর আক্রমণ” চালান (১৬১১), এবং দ্বিতীয়বার আক্রমণ করেন (১৬১৭), যার মধ্যে লুঠপাট অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: ১৬১১ এবং ১৬১৭ উভয় বছরেই এক বছর করে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়নি।
- মুকাররম খান (১৬১৭ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: ওড়িশার গভর্নর।
- ক্ষতির প্রকৃতি: “নির্মমভাবে শহর আক্রমণ করেন এবং অনেক প্রতিমা ভাঙেন”।
- মির্জা আহমদ বেগ (১৬২১ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাগ্নে, ওড়িশার সুবেদার।
- আক্রমণের প্রকৃতি: শ্রীমন্দির আক্রমণ করেন।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: দুই বছর রথযাত্রা বন্ধ ছিল।
পরবর্তী মোগল-যুগের আক্রমণ (১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি – ১৮শ শতাব্দীর প্রথমভাগ)
- আমির মুতাক্কাদ খান / মির্জা মাক্কি (১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: ওড়িশার গভর্নর।
- ক্ষতির প্রকৃতি: “জগন্নাথ পুরী মন্দির আক্রমণ ও লুঠ করেন”।
- আমির ফতেহ খান / মুদবাক খান (১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: আমির ফতেহ খান / মোগল সুবেদার মুদবাক খান।
- ক্ষতির প্রকৃতি: মন্দির আক্রমণ করেন, “হীরা, মুক্তা এবং সোনা সহ মূল্যবান রত্ন” লুঠ করেন। “অবাঞ্ছিত লুঠপাট ও হত্যাকাণ্ড” ঘটান।
- আওরঙ্গজেবের আদেশ এবং একরাম খান (১৬৯২ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: একরাম খান, ওড়িশার নবাব, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সরাসরি আদেশে কাজ করেন।
- ক্ষতির প্রকৃতি: আওরঙ্গজেব “জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ জারি করেন”। একরাম খান “আসলেই মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং এটি ক্ষতিগ্রস্ত করেন”। “কাঠের প্রতিমাগুলি একরাম খান দ্বারা ধ্বংস করা হয়”।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: এই সময়ে একটি গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী বিঘ্ন ঘটে। ১৫ বছরের (১৬৯২-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে ১৩ বছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়নি। সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্পষ্ট আদেশ পূর্ববর্তী স্থানীয় আক্রমণের বিপরীতে, একটি আরও পদ্ধতিগত এবং আদর্শগতভাবে চালিত অভিযানের দিকে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার ফলে দীর্ঘস্থায়ী বিঘ্ন এবং শারীরিক প্রতিমাগুলির আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ ধ্বংসের প্রচেষ্টা দেখা যায়। এটি প্রমাণ করে যে ক্ষতি কেবল বিজয়ের আনুষঙ্গিক ছিল না, বরং ধর্মীয় নীতির একটি ইচ্ছাকৃত কাজ ছিল, যার ফলে গভীরতর এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
- মুহাম্মদ তাকি খান (১৭৩১, ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দ):
- আক্রমণকারী: ওড়িশার নাইব নাজিম (ডেপুটি সুবেদার)।
- ক্ষতির প্রকৃতি: “নির্মম আক্রমণ” চালান এবং “ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ” ঘটান। তাকি খানকে “হিন্দুধর্ম বিরোধী স্বভাবের ব্যক্তি” এবং “মন্দির ধ্বংস করার উদ্দেশ্য” নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
- রীতিনীতির উপর প্রভাব: ১৭৩১ সালে এক বছর এবং তার দ্বিতীয় আক্রমণের পর তিন বছর (১৭৩৩, ১৭৩৪, ১৭৩৫) রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়নি। মুহাম্মদ তাকি খানের মতো গুরুতর আক্রমণ ১৮শ শতাব্দীতেও (১৭৩১, ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দ) অব্যাহত ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে সাম্রাজ্য নিজেই যখন পতনমুখী ছিল তখনও পুরীধাম মোগল-যুগের আগ্রাসনের প্রতি দুর্বল ছিল। এটি বোঝায় যে ক্ষতি একটি একক ঘটনা ছিল না বরং একটি পুনরাবৃত্তিমূলক ধারা ছিল, যা মন্দিরের কার্যক্রম এবং রীতিনীতির জন্য দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল, যার ফলে ধর্মীয় জীবনে ক্রমাগত, দীর্ঘমেয়াদী বিঘ্ন ঘটেছিল।
সংঘটিত ক্ষতির সারসংক্ষেপ
- লুঠপাট ও ধনসম্পদ হরণ: মন্দির থেকে মূল্যবান রত্ন, সোনা এবং অন্যান্য ধনসম্পদ বারবার লুঠ করা হয়েছিল।
- প্রতিমা ধ্বংস ও অপবিত্রকরণ: প্রতিমা ভাঙা হয়েছিল, পোড়ানো হয়েছিল, জলরাশিতে (বঙ্গোপসাগর, গঙ্গা নদী) নিক্ষেপ করা হয়েছিল বা অন্যভাবে অপবিত্র করা হয়েছিল।
- মন্দিরের কাঠামো ও প্রাঙ্গণের ক্ষতি: যদিও মন্দিরটি প্রতিটি ক্ষেত্রে “সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস” হয়নি, এটি “আক্রান্ত” হয়েছিল, “ক্ষতিগ্রস্ত” হয়েছিল, এবং এর প্রাঙ্গণ দখল করা হয়েছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলক বারাবতীতেও কিছু মন্দির ভেঙেছিলেন।
- মানব জীবনের উপর প্রভাব: আক্রমণের সময় “নির্মমভাবে মানুষ নিহত” হওয়ার এবং “অবাঞ্ছিত লুঠপাট ও হত্যাকাণ্ড” এর ঘটনা ঘটেছিল।
- রীতিনীতি ও দৈনন্দিন জীবনের বিঘ্ন: সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং পরিমাপযোগ্য প্রভাব ছিল বার্ষিক রথযাত্রার ঘন ঘন এবং দীর্ঘস্থায়ী স্থগিতাদেশ, কখনও কখনও বহু বছর ধরে। অন্যান্য দৈনন্দিন রীতিনীতিও ব্যাহত হয়েছিল এবং প্রতিমাগুলিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল।
স্থিতিস্থাপকতা ও পুনরুজ্জীবন: সুরক্ষা ও সংরক্ষণের কৌশল
নিরন্তর আক্রমণ সত্ত্বেও, পুরীধামের আধ্যাত্মিকতা ও উপাসনা টিকে ছিল মন্দির পুরোহিত, সেবায়েত এবং স্থানীয় শাসকদের উদ্ভাবনী ও দৃঢ় প্রচেষ্টার কারণে।
দেবতাদের সুরক্ষার জন্য উদ্ভাবনী পদ্ধতি
- প্রতিমা লুকানো ও স্থানান্তর: এটি ছিল সবচেয়ে ধারাবাহিক এবং গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। আক্রমণকারীদের “ক্রোধ থেকে বাঁচতে” পুরোহিত ও সেবায়েতরা প্রতিমাগুলিকে “গোপনে সরিয়ে ফেলতেন”।
- উদাহরণস্বরূপ, প্রতিমাগুলিকে সোনপুরের কাছে গোপালী, একটি গোপন স্থান, চিলিকা হ্রদের কাছে চন্দেই গুহা পাহাড়, চিলিকার কাছে ছাপল্লাই, কপিলেশ্বর, ভার্গবী নদীর উপর দোবান্ধা পেন্টা, খুরদাগড়ের সামনে গোপালজিউ মন্দির, চিলিকায় চাকানাসি/মহিষানাসি, চিলিকায় গুরুবাইগড়া, বানাপুরের মাল (পাহাড়ি) অঞ্চলের আন্ধারিগড়া, চিলিকার কাছে গড়াকোকাই গ্রাম, বানাপুরের বড়া হানতুয়াড়া গ্রাম, চিলিকায় কাঙ্কানাসিখারি কুদা, নয়ারিতে হরিশ্বর মণ্ডপ, খাল্লিকোটে চাকাদিমিবিরি পাহাড়ের কাছে চিকিলি, এবং কোডালায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এই বারবার প্রতিমা লুকানো এবং স্থানান্তরের কৌশল সরাসরি সামরিক প্রতিরোধের পরিবর্তে, সুরক্ষার একটি অভিযোজিত এবং বাস্তববাদী পদ্ধতি তুলে ধরে। এটি এই উপলব্ধিকে নির্দেশ করে যে দেবতার “জীবন” মন্দিরের শারীরিক কাঠামোতে নয়, বরং ‘ব্রহ্মপদার্থ’ এবং উপাসনার ধারাবাহিকতায় নিহিত ছিল, যা এর সংরক্ষণকে মন্দিরের ভবনটির স্থির প্রতিরক্ষার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। এই কৌশলটি বারবার শারীরিক আক্রমণ সত্ত্বেও পুরীধামের আধ্যাত্মিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছিল।
- ‘ব্রহ্মপদার্থ’ সংরক্ষণ: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল কাঠের প্রতিমাগুলির মধ্যে লুকানো পবিত্র ‘ব্রহ্মপদার্থ’ (পবিত্র মূল পদার্থ)। এমনকি যখন প্রতিমাগুলি পুড়িয়ে ফেলা বা ধ্বংস করা হতো, তখনও এই মূল উপাদানটি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের চেষ্টা করা হতো।
- উদাহরণস্বরূপ, কালাপাহাড়ের আক্রমণের পর বিশার মোহান্তি ব্রহ্মপদার্থ সংগ্রহ করে গোপনে কুজাঙ্গাগড়ে রেখেছিলেন।
- ১৬৯২ সালে একরাম খানের আক্রমণের সময়, ব্রহ্মপদার্থ রক্ষা করা হয় এবং বিমলা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে এটি প্রথম দিব্যসিংহ দ্বারা সুরক্ষিত ছিল।
- কাঠের প্রতিমাগুলি পুড়িয়ে ফেলা বা ধ্বংস করা হলেও ‘ব্রহ্মপদার্থ’ রক্ষা করার ধারাবাহিক উল্লেখ এবং নবকলেবরের সময় এর স্থানান্তর একটি গভীর ধর্মতাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উপলব্ধির দিকে ইঙ্গিত করে। এই মূল পদার্থ, যার প্রকৃতি অজানা এবং গোপন রাখা হয়, দেবতার প্রকৃত সারসত্ত্বাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা এটিকে প্রতীকীভাবে অবিনশ্বর করে তোলে। এই বিশ্বাস ব্যবস্থা আধ্যাত্মিক স্থিতিস্থাপকতার একটি প্রক্রিয়া সরবরাহ করেছিল, যা গুরুতর অপবিত্রকরণের পরেও দেবতার “পুনর্গঠন” এবং উপাসনা পুনরায় শুরু করার অনুমতি দেয়, যার ফলে আক্রমণগুলির দীর্ঘমেয়াদী মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব প্রশমিত হয়।
- নবকলেবর অনুষ্ঠান: ‘নবকলেবর’ (১২-১৫ বছর পর কাঠের প্রতিমাগুলির নবায়ন, ব্রহ্মপদার্থ স্থানান্তর) এর অনন্য প্রথা পুরনো প্রতিমা ধ্বংস হয়ে গেলেও নতুন প্রতিমা তৈরির সুযোগ করে দিত, যা উপাসনার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করত। এই অনুষ্ঠানটি ১৪৬ বছর পর প্রথম যযাতি দ্বারা প্রতিমাগুলিকে পুনরায় পবিত্র করার জন্য সম্পাদিত হয়েছিল।
সামরিক প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক আলোচনা
- স্থানীয় শাসকদের প্রতিরক্ষা: প্রতাপরুদ্রদেবের মতো রাজারা “দাক্ষিণাত্য থেকে দ্রুত ফিরে এসে ইসমাইলকে” তাড়িয়ে দেন।
- মোগল হস্তক্ষেপ (কখনও কখনও): ১৫৯২ সালে সুলাইমানের আক্রমণের পর, সম্রাট আকবর মান সিংকে ওড়িশায় পাঠান কার্যকলাপ দমন করতে, যার ফলে রামচন্দ্রদেব প্রথমকে খুরদার শাসক হিসাবে এবং মন্দিরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুনরায় অর্পণ করা হয়।
- কর ও আলোচনা: ১৬১০ সালে কেশোদাশমারু যখন মন্দির দখল করেন, তখন “জাহাঙ্গীরের কাছে তিন লক্ষ টাকা কর প্রদানের মাধ্যমে দেবতাদের পুনরায় মন্দিরে স্থাপন করার পথ প্রশস্ত হয়”।
গজপতি রাজাদের ভূমিকা
গজপতি রাজাকে “প্রভু জগন্নাথের প্রথম সেবক” হিসাবে গণ্য করা হত এবং মন্দির ও এর দেবতাদের সুরক্ষায় তাদের প্রচেষ্টা ছিল কেন্দ্রীয়। তাদের প্রতিশ্রুতি এই বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যে দেবতা ওড়িশার চূড়ান্ত সার্বভৌম ছিলেন এবং মন্দির রক্ষা করা মানেই রাজ্যকে রক্ষা করা।
উপাসনা পুনরায় শুরু
প্রায় প্রতিবারই, হুমকি কমে যাওয়ার পর, প্রতিমাগুলি (বা ব্রহ্মপদার্থ) পুরীতে ফিরিয়ে আনা হতো, প্রয়োজনে নতুন প্রতিমা স্থাপন করা হতো এবং উপাসনা পুনরায় শুরু হতো, প্রায়শই উল্লেখযোগ্য বিরতির পর। উদাহরণস্বরূপ, ১৭৩৬ সালে মুহাম্মদ তাকি খানের মৃত্যুর পর, প্রতিমাগুলি পুরীতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং রথযাত্রা জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়।
Lord Krishna ; ধর্মের দিগ্বিজয়ী রূপ, কেন শ্রীকৃষ্ণ মুরারি ? জেনে নিন সেই ইতিহাস
উপসংহার: পুরীধামের স্থায়ী উত্তরাধিকার
মোগল-যুগের আক্রমণগুলি পুরীধামের উপর গভীর এবং বহুমুখী ক্ষতি সাধন করেছিল। এর মধ্যে মন্দিরের বিপুল সম্পদের ব্যাপক লুঠপাট অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা অনেক আক্রমণকারীর জন্য একটি প্রাথমিক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ, পবিত্র প্রতিমাগুলির ব্যাপক ধ্বংস ও অপবিত্রকরণ ঘটেছিল, যেখানে প্রতিমাগুলি ভাঙা, পোড়ানো এবং জলরাশিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যা জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনের উপর সরাসরি আক্রমণকে প্রতিনিধিত্ব করে। যদিও প্রধান মন্দিরের কাঠামো সময়োপযোগী সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণে প্রায়শই সম্পূর্ণ ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিল, এটি শারীরিক আক্রমণ এবং দখলের শিকার হয়েছিল। শারীরিক ক্ষতির বাইরেও, আক্রমণগুলি দৈনন্দিন রীতিনীতি এবং প্রধান উৎসবগুলিতে গুরুতর বিঘ্ন ঘটায়, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বার্ষিক রথযাত্রার ঘন ঘন এবং দীর্ঘস্থায়ী স্থগিতাদেশ, যা সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক জীবন এবং শহরের ছন্দকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সময়কাল হত্যাকাণ্ড এবং সন্ত্রাসের ঘটনা দ্বারাও চিহ্নিত ছিল।
এই বারবার এবং প্রায়শই নৃশংস আক্রমণ সত্ত্বেও, পুরীধাম অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করেছে। এটি মূলত মন্দির পুরোহিত এবং স্থানীয় শাসকদের উদ্ভাবনী ও নিবেদিত প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছিল, যারা ধারাবাহিকভাবে দেবতাদের, বিশেষ করে পবিত্র ‘ব্রহ্মপদার্থ’ এর সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। প্রতিমাগুলিকে গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখা এবং স্থানান্তরিত করার তাদের কৌশল, যখন সম্ভব সামরিক প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক আলোচনার সাথে মিলিত হয়ে, মন্দিরের মূল আধ্যাত্মিক সারসত্ত্বার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছিল। ‘নবকলেবর’-এর অনন্য ঐতিহ্য প্রতিমাগুলির নবায়ন ও পুনঃস্থাপনের জন্য একটি আচারিক প্রক্রিয়া সরবরাহ করেছিল, যা একটি স্থায়ী আধ্যাত্মিক চক্রের প্রতীক যা শারীরিক ধ্বংসকে অতিক্রম করে।
মোগল যুগে পুরীধামের ইতিহাস বিজয় এবং ধ্বংসের ক্ষমতা এবং বিশ্বাসের অদম্য চেতনার উভয়কেই প্রমাণ করে। মন্দিরটি, ১৮টি আক্রমণ (যার মধ্যে অনেকগুলি মোগল প্রভাবে) থেকে বেঁচে থেকে, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ধারাবাহিকতার একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, এর রীতিনীতি এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অস্থিরতার মধ্য দিয়েও টিকে আছে। এর গল্প গভীর ক্ষতির, কিন্তু শেষ পর্যন্ত, অসাধারণ সহনশীলতা এবং পুনরুজ্জীবনের একটি গল্প।