ব্যুরো নিউজ ২ জুন : “অপারেশন সিঁদুর” সংক্রান্ত সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জেরে কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া ২২ বছর বয়সী ইনফ্লুয়েন্সার ও আইনের ছাত্রী শর্মিষ্ঠা পানোলি বর্তমানে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন। এই মামলার সাম্প্রতিকতম অগ্রগতিতে, বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (BCI)-এর চেয়ারম্যান মানন কুমার মিশ্র পুনের এই আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেছেন।
বার কাউন্সিল প্রধানের সমর্থন
রাজ্যসভার সদস্য এবং বরিষ্ঠ আইনজীবী মানন কুমার মিশ্র শর্মিষ্ঠা পানোলির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন যে তিনি শর্মিষ্ঠার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর গ্রেফতারি এবং ১৩ জুন পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় হেফাজতের নির্দেশ ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, যেখানে বিজেপি নেতারা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমালোচনা করছেন।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ
শর্মিষ্ঠা পানোলির গ্রেফতারি আন্তর্জাতিক মহলেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ডাচ সাংসদ গীরট ওয়াইল্ডার্স (Geert Wilders) এই গ্রেফতারিকে “বাকস্বাধীনতার জন্য কলঙ্ক” বলে অভিহিত করেছেন এবং শর্মিষ্ঠার অধিকার রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছেন। তিনি X-এ পোস্ট করেছেন, “সাহসী শর্মিষ্ঠা পানোলিকে মুক্ত করুন! তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এটা বাকস্বাধীনতার পক্ষে লজ্জাজনক। পাকিস্তান ও হজরত মহম্মদ সম্পর্কে সত্য বলার জন্য তাকে শাস্তি দেবেন না। তাঁকে সাহায্য করুন @narendramodi!”
মামলার খুঁটিনাটি: কী জানা যাচ্ছে?
শুক্রবার রাতে গুরুগ্রাম থেকে শর্মিষ্ঠাকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আইনি নোটিশ পাঠানোর চেষ্টা করা হলে তিনি তাঁর পরিবারের সাথে আত্মগোপন করেছিলেন। স্থানীয় পুলিশ সূত্র অনুযায়ী, শর্মিষ্ঠা পানোলিকে “অপারেশন সিঁদুর” নিয়ে একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টের জেরে গ্রেফতার করা হয়েছে, যেখানে তিনি বলিউড অভিনেতাদের এই বিষয়ে নীরবতার সমালোচনা করেছিলেন। এই পোস্টটি তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বহু ব্যবহারকারী তাঁকে ট্রল করেন এবং হুমকিভরা মন্তব্য পোস্ট করেন। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি ভিডিওটি মুছে দেন এবং ক্ষমা চেয়ে একটি বিবৃতিও জারি করেন। শর্মিষ্ঠাকে শনিবার কলকাতার একটি আদালতে পেশ করা হলে আদালত তাঁকে ১৩ জুন পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠায়।
রাজনৈতিক প্রভাব
শর্মিষ্ঠা পানোলির মামলা রাজনৈতিক মহলেও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমালোচনা করে অভিযোগ করেছে যে তৃণমূল কংগ্রেস “একটি তরুণ হিন্দু মহিলাকে” তাদের ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করার জন্য নিশানা করছে।পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-র সহ-ইনচার্জ অমিত মালব্য (Amit Malviya) তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লাভের জন্য আইনকে “নির্বাচিতভাবে প্রয়োগ” করার অভিযোগ এনেছেন। তিনি X-এ একটি পোস্টে লিখেছেন, “শর্মিষ্ঠা পানোলি, মাত্র ২২ বছর বয়সী, গ্রেফতার হয়েছেন এবং ১৪ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয়েছে এমন একটি ভিডিওর জন্য যা তিনি ১৫ মে ইতিমধ্যেই মুছে ফেলেছেন এবং প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন।” তিনি আরও দাবি করেন যে, তাঁর মন্তব্যের সঙ্গে কোনো সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা যুক্ত না থাকা সত্ত্বেও কলকাতা পুলিশ “অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো” দেখিয়েছে।
আন্ধ্রপ্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণ (Pawan Kalyan) এই ইনফ্লুয়েন্সারকে সমর্থন জানিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যে, যখন তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচিত নেতারা সনাতন ধর্মকে অপমান করেন বলে অভিযোগ ওঠে, তখন কেন একই ধরনের জবাবদিহিতার অভাব দেখা যায়? তিনি প্রশ্ন করেন, “এই ধরনের ক্ষেত্রে কেন কোনো ক্ষোভ, ক্ষমা চাওয়া বা গ্রেফতার হয় না?” ব্লাসফেমির সবসময় নিন্দা করা উচিত বলে জোর দিয়ে কল্যাণ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা একটি দ্বিমুখী রাস্তা হওয়া উচিত এবং তিনি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে ন্যায়সঙ্গতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
কলকাতা পুলিশের বক্তব্য
কলকাতা পুলিশ স্পষ্ট জানিয়েছে যে তারা আইন মেনেই কাজ করেছে। পুলিশের দাবি, শর্মিষ্ঠাকে নোটিস পাঠানোর একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আদালতের নির্দেশে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপর তাঁকে গুরুগ্রাম থেকে গ্রেফতার করে উপযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয় এবং আইনি প্রক্রিয়া মেনে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয়। পুলিশ আরও জানিয়েছে, শর্মিষ্ঠাকে দেশপ্রেম প্রকাশ বা ব্যক্তিগত বিশ্বাস সামনে আনার জন্য গ্রেফতার করা হয়নি, বরং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ছড়াতে পারে এমন আপত্তিকর বিষয় শেয়ার করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এফআইআর-এর বিস্তারিত
জানা গেছে, শর্মিষ্ঠা পানোলির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গার্ডেনরিচ থানায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতার নির্দিষ্ট ধারায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। এই অভিযোগের ভিত্তিতেই পুলিশ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিতর্কিত ভিডিওটি মুছে ফেলার পর শর্মিষ্ঠা ক্ষমাও চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী কাজ করেছে।
পক্ষপাতদুষ্ট পুলিসের অতিসক্রিয়তা
এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। অতীতে রাজ্যে একই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে যখন পুলিশকে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা গেছে, সেখানে “অপারেশন সিঁদুর” সমর্থন না করার জন্য সেলিব্রিটিদের প্রশ্ন করায় একজন তরুণ ইনফ্লুয়েন্সারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি সংবিধানের বাক স্বাধীনতার নির্বিচারে লঙ্ঘন এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের এক জঘন্য উদাহরণ, যা রাজ্যে দুর্নীতি দমনে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই গ্রেফতারি শুধু একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যেখানে বাক স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শর্মিষ্ঠা পানোলির ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে, সমাজে ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য পুলিশের নিরপেক্ষ ভূমিকা অপরিহার্য। এই মামলার ভবিষ্যৎ রায় দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।