Preah Vehar Shiv Mandir conflict

ব্যুরো নিউজ ২৪ জুলাই ২০২৫ : ঐতিহাসিক প্রিহ ভিহেয়ার ( প্রিয় বিহার ) শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সীমান্ত সংঘাত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বৃহস্পতিবার (২৪শে জুলাই, ২০২৫) সকালে বিতর্কিত তা মুয়েন থোম মন্দিরের কাছে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষই F-16 যুদ্ধবিমান ও BM-21 রকেটের মতো বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। থাইল্যান্ডে কমপক্ষে ৯ জন অসামরিক নাগরিক নিহত এবং বহু আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে একটি পাঁচ বছর বয়সী শিশুও রয়েছে। উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অভিযোগ আনছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

 

প্রিহ ভিহেয়ার মন্দির: একটি ঐতিহাসিক মন্দির, বহু দশকের বিবাদের কেন্দ্র

প্রিহ ভিহেয়ার মন্দিরটি ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি প্রাচীন উপাসনালয়, যা নবম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে খেমার সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে নির্মিত হয়েছিল। রাজা সূর্যবর্মণ প্রথম এই মন্দিরের নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এটি প্রাথমিকভাবে একটি হিন্দু মন্দির হলেও, পরবর্তীতে এই অঞ্চলে হিন্দুধর্মের পতন ঘটলে এর বৌদ্ধ ব্যবহারও দেখা যায়। দাংরেক পর্বতমালার একটি কৌশলগত স্থানে অবস্থিত হওয়ায়, মন্দিরটি উভয় দেশের কাছেই অত্যন্ত পবিত্র এবং কাঙ্ক্ষিত। থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া উভয়ই খেমার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে এই মন্দিরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মালিকানা দাবি করে আসছে।

US Threat to India : মার্কিন ‘গুণ্ডামি’ বনাম ভারতের ‘স্বাভিমান’ , ভারত কি পশ্চিমাদের ‘কড়া জবাব’ দেবে?

বিবাদের দীর্ঘ ইতিহাস: উপনিবেশিক যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত

প্রিহ ভিহেয়ার মন্দিরকে ঘিরে এই সংঘাতের শিকড় উপনিবেশিক যুগে নিহিত।

  • উপনিবেশিক যুগ (সিয়াম এবং ফরাসি উপনিবেশ): ১৮৬৭ সালের ফ্রাঙ্কো-সিয়ামী চুক্তির মাধ্যমে এই বিবাদের সূত্রপাত হয়। সিয়াম (আধুনিক থাইল্যান্ড) প্রাথমিকভাবে কম্বোডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করত, কিন্তু ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থাইল্যান্ডকে তার দাবি ত্যাগ করতে হয়। ১৯০৪ সালে, থাইল্যান্ড এবং ফ্রান্স দাংরেক পর্বতমালা বরাবর একটি সীমান্ত স্থাপনে সম্মত হয়, যেখানে জলবিভাজিকা সীমান্ত নির্ধারণের কথা ছিল। তবে, ১৯০৭ সালে একটি ফরাসি মানচিত্রে এই নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রিহ ভিহেয়ার মন্দিরটিকে কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে স্থাপন করা হয়, যদিও জলবিভাজিকা নীতি অনুসারে এটি থাইল্যান্ডের দিকেই পড়তো। থাইল্যান্ড প্রাথমিকভাবে এই মানচিত্রটি গ্রহণ করলেও, ১৯৩০ সালের দিকে তারা দাবি করে যে তাদের প্রতারিত করা হয়েছে এবং প্রিহ ভিহেয়ার থাইল্যান্ডেরই থাকা উচিত।
  • স্বাধীনতা-পরবর্তী এবং আন্তর্জাতিক আদালতের রায়: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর, থাইল্যান্ড ১৯৫৪ সালে প্রিহ ভিহেয়ার মন্দিরটি দখল করে। কম্বোডিয়া এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) উত্থাপন করে। ১৯৬২ সালে, ICJ ৯-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেয় এবং প্রিহ ভিহেয়ার মন্দির কম্বোডিয়াকে প্রদান করা হয়। ICJ-এর যুক্তি ছিল যে থাইল্যান্ড ২৩ বছর ধরে মন্দিরের কম্বোডিয়ান মালিকানা পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে। তবে, ICJ-এর রায় মন্দিরের আশেপাশে ৪.১ বর্গ কিলোমিটার বিতর্কিত জমির বিরোধের সমাধান করেনি, যা এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
  • আজকের সংঘাতের কারণ: সাম্প্রতিক উত্তেজনা ভূমিমাইন বিস্ফোরণের ঘটনার পর বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে থাই সেনারা আহত হয়েছিল। থাইল্যান্ড দাবি করছে যে এই মাইনগুলি সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে, যা কম্বোডিয়া অস্বীকার করেছে। মে মাসে একটি সশস্ত্র সংঘর্ষে একজন কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হওয়ার পর থেকে উভয় দেশের সম্পর্ক মারাত্মকভাবে খারাপ হয়েছে। কম্বোডিয়া আগামী বছর থেকে বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়োগ পুনরায় চালু করার ঘোষণা দিয়েছে, যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। এছাড়াও, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রা এই সংকট মোকাবেলায় তার ভূমিকার জন্য একটি নৈতিক তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন এবং তাকে অফিস থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

বস্তুত এই ইতিহাস প্রমাণ করে যে গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় একসময় সনাতন ধর্মের প্রভাব প্রবল ছিল , তার স্থাপত্য ঘিরে আজ গোটা অঞ্চলে কৌতূহল , যেমন এই কম্বোডিয়াতেই অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম বিখ্যাত বিষ্ণু মন্দির আংকর ভাট !

বর্তমান পরিস্থিতি: F-16 ও BM-21 রকেট হামলা, মানবিক সংকট

বৃহস্পতিবার সকালে তা মুয়েন থোম মন্দিরের কাছে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। থাই সামরিক কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে তারা একটি কম্বোডিয়ান ড্রোন দেখতে পান এবং পরে কম্বোডিয়ান সেনারা থাই সেনা ঘাঁটির কাছাকাছি এসে গুলি চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায়, থাইল্যান্ড অভিযোগ করেছে যে কম্বোডিয়ান বাহিনী BM-21 রকেট ব্যবহার করেছে, যার ফলে তিন থাই বেসামরিক নাগরিক এবং দুই সেনা আহত হয়েছেন। থাইল্যান্ড তাৎক্ষণিকভাবে ছয়টি F-16 যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে এবং কম্বোডিয়ান ব্যাটালিয়নের উপর বোমা হামলা চালায় বলে নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে, কম্বোডিয়া থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে F-16 বোমাবর্ষণের মাধ্যমে সংঘাত বাড়ানোর জন্য “পাশবিক শক্তি” ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে। তারা দাবি করেছে যে তাদের সেনারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে কারণ থাই সৈন্যরা প্রথমে হামলা করেছিল। কম্বোডিয়া জানিয়েছে যে থাই জেটগুলি বিতর্কিত অঞ্চলের কাছে তাদের সামরিক সদর দফতর লক্ষ্য করে বোমা ফেলেছে এবং দুটি কম্বোডিয়ান আঞ্চলিক সামরিক সদর দফতর “ধ্বংস” করেছে।
এই সংঘর্ষের ফলে থাইল্যান্ডে অন্তত ৯ জন অসামরিক নাগরিক নিহত এবং বহু আহত হয়েছেন। সুরিন প্রদেশের দুটি হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং থাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে কম্বোডিয়ান রকেট ফানম ডং রাকে হাসপাতালেও আঘাত হেনেছে। উভয় দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে হাজার হাজার অসামরিক নাগরিককে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

মোদীর ট্রাম্পকে সাফ বার্তা ‘ যুদ্ধ বিরতিতে আপনার কোনও ভূমিকা নেই ‘

কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ও আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া

সংঘাতের কয়েক ঘণ্টা আগে কম্বোডিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে থাইল্যান্ডের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করে এবং ব্যাংকক থেকে তার দূতাবাস কর্মীদের প্রত্যাহার করে নেয়। থাইল্যান্ডও কম্বোডিয়ার সাথে তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং কম্বোডিয়ায় বসবাসকারী তার নাগরিকদের ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছে। কম্বোডিয়া থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং থাইল্যান্ড তার রাষ্ট্রদূতকে কম্বোডিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, যিনি আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান, উভয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতির উপর গভীর নজর রাখছে, কারণ এই সংঘাত অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এই দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিবাদ অবিলম্বে সমাধান না হলে আরও বড় সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বর্তমান ভুরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কম্বজ বা কম্বোডিয়া চীনের মিত্র দেশ এবং থাইল্যান্ড পশ্চিমা উদারপন্থী – সংঘাত প্রবল হলে বহুজাতিক অংশগ্রহণ দেখা যেতে পারে , মধ্যস্থতা এবং সমর্থন , উভয় ক্ষেত্রেই !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর