ব্যুরো নিউজ ২৮ অক্টোবর ২০২৫ : বিহার বিধানসভা নির্বাচন ২০২৫-এর প্রথম দফার ভোটের ঠিক আগেই রাজনৈতিক কৌশলী এবং ‘জন স্বরাজ’-এর প্রধান প্রশান্ত কিশোর (পিকে) গুরুতর আইনি সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছেন। নির্বাচন কমিশনের রেকর্ড থেকে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে যে প্রশান্ত কিশোরের নাম একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার—এই দুই রাজ্যের ভোটার তালিকায় নথিভুক্ত রয়েছে, যা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০ (Representation of the People Act, 1950)-এর সরাসরি লঙ্ঘন।
কোথায় কোথায় পিকে-র নাম নথিভুক্ত?
পিকে-র দুটি ভিন্ন ঠিকানায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে:
- পশ্চিমবঙ্গ (কলকাতা): তাঁর নাম কলকাতার ১২১, কালীঘাট রোড ঠিকানায় নথিভুক্ত। এই ঠিকানাটি তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) প্রধান কার্যালয় হওয়ায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এলাকাটি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের অন্তর্গত। উল্লেখ্য, প্রশান্ত কিশোর ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে টিএমসি-র রাজনৈতিক কৌশলী হিসেবে কাজ করেছিলেন।
- বিহার: তাঁর দ্বিতীয় রেজিস্ট্রেশনটি রয়েছে বিহারে। তিনি বর্তমানে তাঁর ‘জন স্বরাজ’ যাত্রা নিয়ে বিহারে সক্রিয় এবং এটিকে নিজের কর্মক্ষেত্র বলছেন। তাঁর নাম রোহতাস জেলার কোঁয়ার গ্রামের ভোটার তালিকায় নথিভুক্ত, যা তাঁর পৈতৃক গ্রাম।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১৭ নম্বর ধারা স্পষ্টভাবে বলে যে, কোনো ব্যক্তির নাম একাধিক নির্বাচনী এলাকায় নথিভুক্ত থাকতে পারে না। একইভাবে, ১৮ নম্বর ধারা নিশ্চিত করে যে একই এলাকায় কেউ দু’বার ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হবেন না। আইন অনুযায়ী, বাসস্থান পরিবর্তন করলে ফর্ম ৮ পূরণ করে পুরনো তালিকা থেকে নাম সরানোর আবেদন করতে হয়।
যদি প্রমাণিত হয় যে প্রশান্ত কিশোর ইচ্ছাকৃতভাবে দুটি রাজ্যে নিজের নাম রেখেছেন এবং নিয়ম মেনে পুরনো নাম সরানোর আবেদন করেননি, তবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন কমিশন এই ক্ষেত্রে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণার প্রক্রিয়াও শুরু করতে পারে।
টিম পিকে-র সাফাই এবং বিতর্কের মোড়
এই গুরুতর বিতর্ক নিয়ে প্রশান্ত কিশোর নিজে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে, তাঁর দল ‘জন স্বরাজ’-এর এক প্রবীণ সদস্য সাফাই দিয়ে বলেছেন যে, “পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের পর প্রশান্ত কিশোর বিহারে ভোটার কার্ড তৈরি করিয়েছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গের কার্ডটি বাতিল করার জন্য আবেদনও করেছেন। এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।” তবে, পশ্চিমবঙ্গের তালিকা থেকে নাম বাতিল হয়েছে কি না, সে বিষয়ে দলটি স্পষ্ট করে বলতে পারেনি।
এই বিতর্কটি এমন এক সময়ে সামনে এলো যখন নির্বাচন কমিশন (EC) সারা দেশে ডুপ্লিকেট ভোটারদের শনাক্ত করার জন্য বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) অভিযান চালাচ্ছে। এখন সকলের নজর নির্বাচন কমিশন এই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয় সেই দিকে।
ভোট-কৌশলী, নাকি ভোট-লুটের কারিগর?
ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর তাঁর কৌশলের আড়ালে বহু রাজ্যে ক্ষমতার অলিন্দে থাকার চেষ্টা করেছেন।
- পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে: ‘ভাতা-ভিক্ষার রাজনীতি’—২০২১ সালের নির্বাচনে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসকে টিকিয়ে রাখার জন্য জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর রচয়িতা হন, যা পরে ভোটের ঠিক আগে ভাতার অঙ্ক বাড়িয়ে এক প্রকার ‘ভাতা ভিক্ষার রাজনীতিতে’ পরিণত হয়, যার ফলে কিছু সাধারণ মানুষের মতামত বিক্রি হয়ে যায়।
- ‘বহিরাগত’ নীতি: তিনি বাঙালি-অবাঙালি ভেদাভেদ তৈরি করে তৃণমূল কংগ্রেসকে একটি আঞ্চলিক শক্তির মূল হিসেবে তুলে ধরেন, অথচ এখন বোঝা যাচ্ছে যে তিনি নিজেই ভবানীপুর কেন্দ্রের একজন ‘বহিরাগত’ ভোটার।
- IPAC-এর ভূমিকা: তাঁর পরিচালিত সংস্থা IPAC ভোট কৌশলের নামে জাল নথি, কর্মী ও আধিকারিকদের ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘দিদিকে বলো’ বা ‘পাড়ায় সমাধান’ সহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিনা যাচাইয়ে অনুপ্রবেশকারী পরিবারদের ডোমিসাইল সার্টিফিকেট দেওয়া, যা রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য, এই সংস্থার কার্যকলাপের কিছু উদাহরণ।
প্রশ্ন উঠছে, প্রশান্ত কিশোর কি নিছকই ভোট-কৌশলী, নাকি ভোট-লুটের কারিগর? বিহারে নিজের দল গঠন করেও যেখানে ভোটে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলেন না, অথচ এই পশ্চিমবঙ্গেই বারবার ভোট-লুটের পরিকল্পনা কার্যকর করেছেন – দুর্নীতির আশ্রয়েই বোধ হয় সম্ভব।




















