ব্যুরো নিউজ ০৬ অক্টোবর ২০২৫ : প্রবল বৃষ্টি এবং ভূমিধসের কারণে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকৃতির রোষে বিপর্যস্ত এই অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখতে গতকাল, সোমবার, উত্তরবঙ্গ সফরে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে, এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
পাহাড়ের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ ও পদক্ষেপ
পাহাড়ের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজেই বিপর্যস্ত এলাকাগুলি সরেজমিনে দেখতে চান। ইতিমধ্যেই তিনি মুখ্যসচিব, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং সেচ দফতরের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন। নবান্নেও একটি বিশেষ কন্ট্রোল রুম তৈরি করা হয়েছে, যেখান থেকে উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে জানিয়েছেন, গত রাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হঠাৎ প্রবল বৃষ্টিপাত এবং বাইরে থেকে (ভুটান ও সিকিম) রাজ্যে নদীর অতিরিক্ত জল প্রবেশের কারণে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিনি জানান, “গতকাল রাতে উত্তরবঙ্গে ১২ ঘণ্টায় ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং একই সঙ্গে সঙ্কোশ নদীতে অতিরিক্ত জলপ্রবাহ এবং ভুটান ও সিকিম থেকে নদীর জল ঢুকেছে। এর ফলেই এই বিপর্যয় ঘটেছে।”
তিনি শোক প্রকাশ করে বলেন, “প্রবল বৃষ্টি এবং নদীর বন্যায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের কিছু ভাই ও বোনকে হারিয়েছি জেনে আমরা মর্মাহত ও দুঃখিত। আমি নিহতদের পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাই এবং অবিলম্বে পরিবারগুলিকে সমস্ত সহায়তা পাঠাব।” তিনি আশ্বাস দিয়েছেন যে সরকারের তরফে দায়িত্ব নিয়ে সকল পর্যটকদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে এবং হোটেল মালিকদের কাছে এই সঙ্কটকালে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়ার আবেদন করেছেন।
অত্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত হলে স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ি অঞ্চলের নদী তিস্তায় তার প্রভাব পড়বে। আর এই নদী যখন ভুটান, সিকিম এবং উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রবাহিত হয়, তখন সেই নদীর আশেপাশের সমস্ত অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রশ্ন তখন ওঠে যে আঞ্চলিক প্রশাসন কতটা তৎপর ছিল।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি , তৃণমূল কংগ্রেস প্রশাসনের ব্যর্থতা স্পষ্টভাবে তাদের বক্তব্যে তুলে ধরেছে।
কেন্দ্রীয় সাহায্যের আশ্বাস ও বিরোধী দলের তোপ
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সবরকমের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
শমীক ভট্টাচার্য্যের বক্তব্য: “মুখ্যমন্ত্রীর দুর্গাপূজা কার্নিভাল বাতিল করে যাওয়া উচিত ছিল উত্তরবঙ্গে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতেই পারে কিন্তু এই সরকার সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্যর্থ। তাদের দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিভিন্ন পৌর সংস্থার জল নিকাশির ব্যবস্থা পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেনি। সুতরাং আজ অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই, এই সরকার যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ মানুষের দুর্ভোগ করে যাবে।”
পূজার আগে ঘটে যাওয়া কলকাতার প্লাবন নিয়ে তিনি বলেন, “১২ জন মানুষ কলকাতায় প্রাণ হারালো, আম্ফান থেকে প্রশাসন কোনো শিক্ষা নেয়নি বোঝা গেল। উত্তরবঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা ২১ ছাড়িয়ে গেছে তার মধ্যে বিজেপির পরিবারও আছে। আমাদের সমস্ত সংগঠন ও কর্মীরা মানুষের সাহায্যে উত্তরবঙ্গে ত্রাণ কাজ করছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এনডিআরএফ যথাযথভাবে সক্রিয় হয়েছে এবং সিকিমে আটকে পড়া বহু পর্যটকদের সাহায্যের জন্য ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা বিপ্লব দেব সিকিম সরকারের সাথে সংযোগ রেখে চলেছেন। সিকিম সরকার বলেছেন যে একটি রাস্তা পশ্চিমবঙ্গের দিকে চালু আছে, সেটা ধরে সমস্ত পর্যটককে নিরাপদে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছে।”
বিজেপি নেতা অর্জুন সিংয়ের বক্তব্য: “বছরে একদিন মাটি বের করলে নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক হয়না, পূজার সময় বৃষ্টি আসে তখন এই সরকারের মাটি বের করার কাজ চালায়। এই সরকার কোনো পূর্ব পরিকল্পনা করেনা, কাজ করে না। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করার জন্য খালি পরিকল্পনা করে। বারো জন লোক মারা গেল কলকাতায়, মমতা ব্যানার্জি ডান্ডিয়া খেলছিলেন। পিতৃপক্ষে হিজাব পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গতকাল উত্তরবঙ্গে এতজন লোক মারা গেল কিন্তু মমতা ব্যানার্জি কার্নিভাল করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “মমতা ব্যানার্জির হিম্মত নেই ফিরহাদ হাকিমকে কলকাতার প্লাবনের জন্য দায়ী করে মেয়রপদ থেকে সরানোর। উনি অভিযোগ করলেন সিইএসসি-র (CESC) বিরুদ্ধে কিন্তু সিইএসসি-র বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন? এঁনারা ওনার বিজনেস পার্টনার আছে।”
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও বন্যপ্রাণীর দুর্দশা
প্রবল ধসের কারণে দার্জিলিং সহ একাধিক এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। একাধিক জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ। সিকিম এবং মিরিকের সাথে যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন। তিস্তা ও তোর্সার মতো নদীগুলি ফুঁসছে।
বৃষ্টিতে শুধু পাহাড়ই নয়, তরাই এবং ডুয়ার্সও তিস্তা-তোর্সার জলে ভাসছে। জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারেও বন্যা পরিস্থিতি। জঙ্গল ও পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে পৌঁছে গেছে হাতির দল, এবং নদীতে গণ্ডার ভেসে আসার খবরও পাওয়া গেছে। বন্যপ্রাণীরাও চরম দুর্ভোগের শিকার।



















