Bishnupur lost history of bengal ride

শুদ্ধাত্মা মুখার্জি , ১০ আগস্ট ২০২৫ : এক শনিবারের দুপুরে , ঘন অরণ্য অতিক্রম করে বাইকের চাকা যখন বিষ্ণুপুরের লাল মাটির পথে গড়াল, তখন আমি শুধু একা ছিলাম না। আমার সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রী এবং সামনে আমাদের জন্য পথ দেখাচ্ছিলেন আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড। তিনি নিজের বাইকে করে আমাদের এই মধ্যযুগীয় শহরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে আমি দিনে ৪৫০ টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে পথ নির্দেশক করেছিলাম। এই যাত্রায় আমরা শুধুই মন্দির দেখছিলাম না, গাইড থেকে শুনছিলাম বিষ্ণুপুরের প্রতিটি ইট-পাথরের পেছনে লুকিয়ে থাকা গল্প। জয়পুর জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত এই শহরটি আসলে মন্দির দিয়ে তৈরি একটি শহর, যা পশ্চিমবঙ্গের এক অনবদ্য ঐতিহ্য।

 

ইতিহাসের গাইড ও মন্দিরের রহস্য

আমাদের গাইড, যিনি স্থানীয় মানুষ, নিজের বাইকে আমাদের পথ নির্দেশ করছিলেন। তিনি আমাদের প্রথমে রাঙামাটির মধ্য দিয়ে নিয়ে গেলেন, যেখানে মল্ল রাজাদের পুরোনো রাঙামাটির ঘরগুলি ছিল। তার কথায় উঠে এলো বীর হাম্বিরের গল্প। বীর হাম্বিরের (১৫৬৫-১৬২০ খ্রিষ্টাব্দ) সময় থেকেই বিষ্ণুপুরের গৌরব শুরু। তিনি কীভাবে শ্রীনিবাস আচার্যের ভাগবত পাঠে মুগ্ধ হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মদনমোহন হয়ে ওঠেন মল্ল রাজাদের কুলদেবতা।
গাইডের কাছ থেকে জানা গেল, হাম্বির কীভাবে বৃষভানুপুর থেকে মদনমোহনের মূর্তি চুরি করে এনেছিলেন। এই গল্প শুনতে শুনতে আমরা জোড় বাংলা মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এই অসাধারণ টেরাকোটার মন্দিরটির সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রী মুগ্ধ হয়ে তার কারুকার্য দেখছিল। গাইড আমাদের প্রতিটি টেরাকোটার প্যানেলের পেছনের গল্প বলছিলেন, যা কৃষ্ণলীলা থেকে রামায়ণের কাহিনী পর্যন্ত বিস্তৃত। আমি বাইকে করে তার পিছু নিচ্ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম, ইতিহাসের এমন এক জীবন্ত গাইড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

Rathayatra : মালদা কালিয়াচকের ৬২৯ বছরের রথ ও মেলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

দলমাদল কামান: যখন মানুষের বিশ্বাসই ভরসা

আমাদের বাইক যখন দলমাদল কামানের সামনে থামল, তখন সূর্যের আলোয় তার লোহার শরীর ঝকঝক করছিল। গাইড আমাদের গোপাল সিং দেবের সময়ের (১৭১২-১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ) সেই যুদ্ধের গল্প শোনালেন, যখন বর্গিরা আক্রমণ করেছিল। রাজা গোপাল সিং সামরিক শক্তি ব্যবহারের বদলে ঈশ্বরের ওপর ভরসা করেছিলেন।
গাইড যখন সেই রাতের মদনমোহনের অলৌকিক উপস্থিতির কথা বলছিলেন, তখন আমার স্ত্রী ও আমি দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। একজন নীল পোশাক পরা বালক এসে কীভাবে একা হাতে কামান চালিয়ে বর্গিদের তাড়িয়ে দিয়েছিল এবং পরে দেখা যায় যে মন্দিরে মূর্তির হাতে বারুদের দাগ ছিল, সেই গল্প তিনি এমনভাবে বলছিলেন যেন তিনি নিজেই সেই ঘটনার সাক্ষী।
এই কামানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম, যে ঔপনিবেশিক ইতিহাস হয়তো অন্য কথা বলে, কিন্তু প্রকৃত লোকগাথায় মানুষের বিশ্বাস যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তা এখানে না এলে বোঝা যেত না। আমার বাইকের চাকা এই বিশ্বাস আর ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে।

Puri Jagannath Dham : কেন শ্রীক্ষেত্র পুরীর বিকল্প সম্ভব নয় ? আধ্যাত্মিকতা এবং অদম্য প্রতিরোধের বহু শতাব্দীর ইতিহাস !

অভিশাপ ও উপেক্ষিত ঐতিহ্য: পূর্বতন এবং বর্তমান রাজ্য সরকারের উদাসীনতা

বাইক চালাতে চালাতে আমরা মদনমোহন মন্দিরে পৌঁছলাম, যা রাজা দুর্জন সিং দেব ১৬৯৪ সালে তৈরি করেছিলেন। এখানে এসে গাইড আমাদের সেই করুণ গল্পটি শোনালেন, কীভাবে পুরোহিতের অভিশাপ সত্যি হয়েছিল এবং রাজা চৈতন্য সিং দেব দেনার দায়ে মদনমোহনের আসল মূর্তিটি বন্ধক রাখতে বাধ্য হন, যা আর কোনোদিন বিষ্ণুপুরে ফিরে আসেনি।
এই মন্দিরটি বিষ্ণুপুরের অন্যতম সেরা স্থাপত্য হলেও, এর বর্তমান অবস্থা দেখে আমার মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। গাইড জানালেন, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ নজর দেওয়া হয় না। রাতে মন্দিরটি আলোকিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই এবং আর্থিক সংকটে ঐতিহ্যবাহী হিন্দু উৎসবগুলোও জৌলুসহীন হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আমার মনে এক গভীর হতাশা জন্মাল। পশ্চিমবঙ্গে এত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও সরকার নতুন নতুন ধর্মীয় স্থান তৈরিতে মনোনিবেশ করছে, যা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ঐতিহ্য অনুকরণ করে। অথচ বিষ্ণুপুরের মতো আসল বঙ্গীয় ইতিহাস অবহেলিত। আমার স্ত্রী ও আমি দুজনেই এই অপ্রয়োজনীয় সরকারি নীতির কারণে হতাশ হলাম। পশ্চিমবঙ্গের সত্যিকারের ঐতিহ্য সংরক্ষণ না করে, নতুন ও নকল কিছু তৈরি করার এই প্রবণতা এক বাঙালি বাইকার হিসেবে আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে।

বিষ্ণুপুর ভ্রমণ আমার কাছে কেবল এক বাইক রাইড ছিল না। এটি ছিল ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস এবং বর্তমানের এক হতাশাজনক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এক বাইক রাইড। বাইকের গতি যতই বাড়ুক না কেন, বিষ্ণুপুরের এই গল্পগুলো আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর