ব্যুরো নিউজ ০৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২৫ : পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে কলকাতা ময়দানে সেনাবাহিনীর একটি মঞ্চ সরানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। গত সোমবার গান্ধী মূর্তির কাছে তৃণমূল কংগ্রেসের একটি প্রতিবাদ মঞ্চ ভেঙে দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই মঞ্চটি রাজ্যের বাইরে অন্য রাজ্যে বসবাসকারী বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর কথিত অত্যাচারের প্রতিবাদে তৈরি করা হয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
সেনা বনাম তৃণমূল: মঞ্চ সরানোয় মমতার অভিযোগ, সেনার পাল্টা যুক্তি
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিবাদ মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাকে “অপব্যবহার” করার অভিযোগ এনেছেন। তিনি এই পদক্ষেপকে “অনৈতিক” এবং “অগণতান্ত্রিক” বলে আখ্যা দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ” আমাকে দেখে ২০০ সেনা দূরে চলে গেলেন ! আমি সেনাবাহিনীকে দোষ দিই না, কিন্তু এর পেছনে বিজেপির প্রতিশোধের রাজনীতি রয়েছে। এই ‘ডাবল-ইঞ্জিন’ সরকারই এর জন্য দায়ী। তারা সেনাকে অপব্যবহার করছে। এটি অনৈতিক এবং অগণতান্ত্রিক।”
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন যে, মঞ্চটি সরানোর আগে সেনাবাহিনীর কলকাতা পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, “ওরা আমাকে ডাকতে পারতেন, আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে মঞ্চটি সরিয়ে দিতাম। আমি সেনাবাহিনীকে দোষ দিই না, কেবল তাদের কাছে আবেদন করছি নিরপেক্ষ থাকার জন্য এবং বিজেপির হাতে নিজেদের খেলার পুতুল না হওয়ার জন্য।”
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ অভিযোগ করেন, “ইডি এবং সিবিআই-এর পর বিজেপি সরকার এবার সেনাকে মাঠে নামিয়েছে।” তিনি জানান, দল গান্ধী মূর্তির সামনের প্রতিবাদস্থলটি রানি রাসমণি রোডে স্থানান্তরিত করবে।
এর প্রতিক্রিয়ায়, এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানান যে ভারতীয় সেনাবাহিনী (কলকাতা লোকাল মিলিটারি অথরিটি) সর্বোচ্চ দুদিনের জন্য ময়দানে কোনো অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়, যা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী হয়ে থাকে। তিন দিনের বেশি সময়ের জন্য কোনো অনুমতি প্রয়োজন হলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কাছ থেকে তা নিতে হয়। ওই কর্মকর্তা জানান যে, তৃণমূলের মঞ্চটির জন্য দুই দিনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটি প্রায় এক মাস ধরে ছিল। মঞ্চটি সরানোর জন্য সংগঠকদের কাছে একাধিকবার অনুরোধ পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তা মানা হয়নি। এরপর কলকাতা পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী মঞ্চটি সরানোর কাজ শুরু করে।
বিধানসভাতেও উত্তাপ: শুভেন্দু অধিকারীর সাসপেনশন
সেনা-তৃণমূল সংঘাতের ঢেউ এসে পড়ে রাজ্য বিধানসভাতেও। মঙ্গলবার বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিনের জন্য বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে সাসপেন্ড করেন। তৃণমূল কংগ্রেস বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা করে একটি প্রস্তাব পেশ করলে শুভেন্দু অধিকারীর বারবার অধিবেশন বাধা দেওয়ার অভিযোগে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। স্পিকার বলেন, “বারবার অধিবেশনে বাধা দেওয়ায় আমি আপনাকে আজকের জন্য সাসপেন্ড করতে বাধ্য হচ্ছি।” এর প্রতিবাদে শুভেন্দু অধিকারী এবং বিজেপি বিধায়করা স্লোগান দিতে দিতে ওয়াকআউট করেন।
নিজের পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি দিয়ে শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেন, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু তার বক্তব্যে সেনাবাহিনীকে অপমান করেছেন। বিধানসভা থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমি তখনই আপত্তি জানাই যখন বসু সোমবারের সেনা পদক্ষেপের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের তুলনা করেন, যেখানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছিলেন।”
এদিকে, ব্রাত্য বসু দাবি করেছেন যে শুভেন্দু অধিকারী তার মন্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন। বসু বলেন, তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন এবং ভাষা রক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষের ত্যাগের সঙ্গে সোমবারের ঘটনার একটি সাদৃশ্য তুলে ধরেছিলেন। যদিও ভারতীয় সেনার সাথে পাক সেনার ভাষা আন্দলোনের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও রকম সাদৃশ্য নেই । একজন শিক্ষা মন্ত্রীর থেকে এই মন্তব্য সত্যি নেতিবাচক !
শুভেন্দু বলেন, “আমাদের মহান সেনাবাহিনীর জয়ধ্বনি দেওয়ার জন্য স্পিকার আমাকে সাসপেন্ড করেছেন। সব বিজেপি বিধায়ক বসু-র সেনা-বিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদে স্লোগান দিয়েছেন। আমরা ওয়াকআউট করেছি।”
সেনাকে পাকিস্তানের দালাল বলায় শুভেন্দুর ক্ষোভ, মমতার ক্ষমা চাওয়ার দাবি
ব্রাত্য বসুর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেন যে, তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও বিধায়করা সবাই ‘পাকিস্তানের দালাল’ কারণ তারা ভারতীয় সেনাকে দোষারোপ করে কর্তব্য পালনের জন্যে । এরপর রাতে তিনি মেয়ো রোডে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে তিনি বলেন: “দেশ বিরোধী কাজ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উনি বলেছেন সেনা বাহিনী ওনাকে দেখে পালিয়েছেন। যে সেনা ভারতের শত্রুদের গুঁড়িয়ে দিয়েছেন নানা সংঘাতে, সেই সেনা পলায়ন করতে পারে না কোনোদিন। আপনি সেনাদের অপমান করেছেন, ভাষা সংযত করুন মুখ্যমন্ত্রী, ক্ষমা চান ভারতীয় সেনার কাছে। ভারতীয় সেনা কোনোদিন রাজনীতি করে না। বিজেপি দ্বারা সেনা বাহিনী চলে ? বড় আপত্তিকর কথা বলেছেন।” তিনি গোটা বাংলা এবং দেশের মানুষকে “বাংলার লজ্জা, দেশের লজ্জা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের” বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, অতীতেও শুভেন্দু অধিকারী এবং বিজেপি বিধায়কদের বিরুদ্ধে বিধানসভার কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর আগে জুন মাসে বিধানসভার মার্শালদের বিরুদ্ধে বিজেপি বিধায়কদের মারধরের অভিযোগ উঠেছিল, যদিও তৃণমূলের পক্ষ থেকে সেই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছিল।