নিজস্ব সংবাদদাতা , ২১ জুন : গত ৬ই মে ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ডের কিং চার্লস তৃতীয়ের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল না, বরং আধুনিক বিশ্বে স্থায়িত্ব এবং ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। রাজা তাঁর প্রপিতামহ এবং আরও পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি রাজকীয় পোশাক ও অনুষঙ্গ পুনরায় ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা তাঁর পরিবেশ সচেতনতা এবং রাজতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার প্রতিফলন ঘটায়।
ঐতিহাসিক পোশাকগুলির পুনরাবর্তন
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আর্চবিশপ অফ ক্যানটারবেরি দ্বারা যখন কিং চার্লস তৃতীয়কে মুকুট পরানো হয়, তখন তিনি বেশ কিছু ঐতিহাসিক পোশাক পরিধান করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
- ‘কলোবিয়াম সিন্ডোনিস’ (Colobium Sindonis): এটি ছিল একটি সাদা লিনেনের আলখেল্লা সদৃশ পোশাক, যা ভেতরের স্তরে পরা হয়। কিং জর্জ ষষ্ঠ-এর রাজ্যাভিষেকের সময় থেকে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
- ‘সুপারটুনিকা’ (Supertunica): এটি একটি সোনালি রঙের লম্বা হাতাওয়ালা পোশাক, যা ‘ইম্পেরিয়াল ম্যান্টল’-এর নিচে পরা হয়। এর উপর মধ্যযুগীয় চার্চের পোশাকের আদলে জটিল এমব্রয়ডারি রয়েছে, যা ১৯১১ সালে কিং জর্জ পঞ্চম-এর রাজ্যাভিষেক থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
- ‘ইম্পেরিয়াল ম্যান্টল’ (Imperial Mantle): রাজকীয় পোশাকগুলির মধ্যে এটিই সবচেয়ে পুরোনো, যা ১৮২১ সালে কিং জর্জ চতুর্থের রাজ্যাভিষেক থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সোনা, রূপা এবং রেশমের সুতো দিয়ে তৈরি এই অসাধারণ পোশাকটিতে গোলাপ, থিসল, শেমরক ও ঈগলের মতো বিভিন্ন জাতীয় প্রতীক বুনন করা আছে।
- ‘করোনেশন সোর্ড বেল্ট’ (Coronation Sword Belt): ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিটি রাজ্যাভিষেকের জন্য নতুন করে তৈরি হলেও, এবার কিং চার্লস তাঁর প্রপিতামহ কিং জর্জ ষষ্ঠ-এর ব্যবহৃত বেল্টটি পুনরায় ব্যবহার করেন। এই বেল্টটি ‘জুয়েলড সোর্ড অফ অফারিং’ ধারণ করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং আর্চবিশপ এটি রাজাকে অর্পণ করার সময় ভালোকে রক্ষা ও মন্দকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলেন।
- ‘করোনেশন গ্লাভ’ (Coronation Glove) বা গন্টলেট: ডান হাতের জন্য তৈরি এই বিশেষ দস্তানাটিও কিং জর্জ ষষ্ঠের ব্যবহৃত গ্লাভটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই দস্তানাটি মুকুট পরানোর সময় রাজকীয় রাজদণ্ড (Sceptre) ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।
পরিবেশ সচেতনতার বার্তা
এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলির প্রতিটিই তার নিজস্ব ইতিহাস এবং কারুকার্যের জন্য সুপরিচিত। যেমন ‘সুপারটুনিকা’-এর উপর জটিল এমব্রয়ডারি লেডিস ওয়ার্ক সোসাইটি দ্বারা করা হয়েছিল। এই পোশাকগুলি পুনরায় ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কেবল রাজকীয় ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণই রাখেনি, বরং পরিবেশ সচেতনতা এবং টেকসই জীবনযাত্রার একটি শক্তিশালী বার্তাও দিয়েছে। এটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, পুরোনো দিনের জিনিসপত্র সংরক্ষণ এবং পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে আধুনিক যুগেও পরিবেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা যায়।
এভারেস্টের উচ্চতা প্রথম নিরূপণ করেছিলেন একজন বাঙালি গণিতবিদ
রাজপরিবারের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা
কিং চার্লস তৃতীয়ের এই পদক্ষেপ রাজপরিবারের ধারাবাহিকতা এবং ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার এক প্রতীক। এর মাধ্যমে তিনি কেবল তাঁর পূর্বপুরুষদের পোশাকই গ্রহণ করেননি, বরং তাঁদের রেখে যাওয়া নীতি এবং মূল্যবোধকেও সম্মান জানিয়েছেন। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে, ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন বিশ্ব পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি। এই রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানটি ইতিহাসের পাতায় একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, যেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মেলবন্ধন ঘটেছে রাজার পোশাকে।
– লেখক মিঠুন