ব্যুরো নিউজ ০৩ জুলাই : কসবা আইন কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্র আর তার সহযোগী জইব এবং প্রনিতদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর ও বিকৃত মানসিকতার পরিচয় মিলেছে। পুলিশি তদন্তে ও আদালতের শুনানিতে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, নির্যাতিতা তরুণীর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, যা অভিযুক্তদের চরম বেপরোয়া ও বিকৃত স্বভাবের ইঙ্গিত দেয়।
নির্যাতিতার উপর অমানবিক আচরণ
পুলিশি সূত্রে জানা গেছে, কসবা আইন কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্রের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়েছে পুলিশ। অভিযুক্তের শরীরে নির্যাতিতা তরুণীর নখের আঁচড়ের চিহ্ন পেয়েছেন চিকিৎসকরা। পুলিশি সূত্র জানাচ্ছে, এই চিহ্ন থেকে স্পষ্ট যে আক্রমণের সময় নির্যাতিতার সঙ্গে অভিযুক্তের মধ্যে প্রবল ধস্তাধস্তি হয়েছিল। এর আগে, নির্যাতিতার মেডিকেল পরীক্ষাও ধর্ষণের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। যেখানে ডাক্তাররা বলেছিলেন যে অভিযুক্তের শরীরে কামড়ের চিহ্ন এবং নখের আঁচড় পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে মর্মান্তিক তথ্য হলো, আলিপুর আদালতে শুনানির সময় সরকারি আইনজীবী সৌরিন ঘোষাল একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আনেন। তিনি আদালতকে জানান, নির্যাতিতাকে সুস্থ করতে ইনহেলার ব্যবহার করা হয়নি, বরং উদ্দেশ্য ছিল স্বাভাবিক করে আরও বেশি নির্যাতন চালানোর। তিনি বলেন, ২৪ বছর বয়সী আইনের ছাত্রী যখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং অসুস্থ বোধ করেন, তখন তাকে ইনহেলার দেওয়া হয়েছিল উদ্বেগের কারণে নয়, বরং যাতে সে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং আবার ধর্ষণের শিকার হয়। এই বক্তব্য আদালতে শুনিয়ে সরকারি পক্ষ দাবি করে, মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্র এবং তার দুই সহযোগী জাইব আহমেদ ও প্রমিত মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে এই অপরাধ ঘটিয়েছে।
পর্ন-কাণ্ডে ‘ফুলটুসি’ শ্বেতা খান অবশেষে গ্রেফতার, চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে
অভিযুক্তদের বিকৃত ও অপরাধমূলক স্বভাব
পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে যে, মহিলাদের উত্যক্ত করা, তাদের ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে বাধ্য করিয়ে যৌন নিগ্রহ করা, ভিডিও তুলে ব্ল্যাকমেইল করা, মনোজিত মিশ্রের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। সূত্রের খবর, রাজনৈতিক কানেকশনের দাপট দেখিয়ে জুনিয়র ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করা যেন রোজকার ব্যাপার হয়ে উঠেছিল তার কাছে। জাইব আহমেদ এবং প্রমিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে সে কার্যত একটি ‘সিন্ডিকেট’ চালাত।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জাইব এবং প্রমিতের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তারা মনোজিত ওরফে ম্যাঙ্গো দাদার নির্দেশ পালনেই মহিলাদের অশালীন ভিডিও করা, এবং সেগুলি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠানোর মতো কাজ করত। বছরে দু’বার করে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করত ম্যাঙ্গো। সেই পিকনিকই ছিল তার ‘শিকার’ করার জায়গা। আগে থেকেই সে ছকে নিত প্রথম বর্ষের কোন ছাত্রীকে তার ‘চাই’। দাদার নির্দেশ মতো তার শাগরেদরা সেই ব্যবস্থা করত।
পিকনিকে যাওয়ার সময় ‘টার্গেট’-কে দাদার পাশে বসানোর ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে, পিকনিক স্পটে গিয়ে নিরিবিলি জায়গা খুঁজে দেওয়া। কিংবা টার্গেট হওয়া সেই ছাত্রীর অশালীন ভিডিও রেকর্ড করার মতো কাজ পড়ত জাইব এবং প্রমিতের কাঁধে। আকণ্ঠ মদ্যপান করে মহিলাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করত মনোজিৎ। পিকনিক স্পটের সেই সমস্ত ‘কুকীর্তি’ দেখিয়েই তারপর ব্ল্যাকমেল করত ম্যাঙ্গো। ছাত্রীর বাড়িতে ভিডিও দেখিয়ে দেওয়ার ভয়, কলেজে ফেল করিয়ে দেওয়ার আতঙ্ক কিংবা ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বাধ্য করত ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে। সেক্ষেত্রে কলেজের গার্ডরুমই ছিল তার আস্তানা। সেখানেই নিয়ে যেত টার্গেট করা ছাত্রীদের। আর তারা বাধা দিলেই ধর্ষণ।
প্রভাবের আড়ালে নৈরাজ্য ; জানুন রাজনৈতিক মদতপুষ্ট ধর্ষকের চরিত্র ।
ন্যায়বিচারের আশায় নির্যাতিতারা
লোকলজ্জার ভয় কিংবা ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আতঙ্কে মনোজিতের যৌন হেনস্থার শিকার হয়েও অনেকে চুপ ছিলেন। নির্যাতিতার পুলিশে অভিযোগ দায়েরের পর অনেকেই একে একে সাহস করে নিজেদের উপর হওয়া অত্যাচার নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। কেউ কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কেউ বা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন মানসিক ট্রমা।
প্রসঙ্গত, ক্যাম্পাসের সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা যাচ্ছে যে অভিযুক্তরা নির্যাতিতা তরুণীকে কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার আলিপুর এসিজেএম আদালতে মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্র সহ ধৃত চারজনকে পেশ করা হয়। আদালত ৮ জুলাই পর্যন্ত তিন অভিযুক্তের পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। পুলিশি তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।