ব্যুরো নিউজ ৫ আগস্ট ২০২৫ : তৃণমূল কংগ্রেসে (TMC) এক নাটকীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। সোমবার লোকসভায় দলের মুখ্য সচেতকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন বর্ষীয়ান সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ইস্তফার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দলের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভার দলনেতার পদ থেকে প্রবীণ নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরিয়ে সেই দায়িত্ব তুলে দেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। এই দুটি ঘটনা একই দিনে ঘটায় তৃণমূলের সংসদীয় রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
১. ক্ষোভ ও অপমানের জেরে ইস্তফা কল্যাণের
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনি সংসদ সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এই অসন্তোষের দায় তাঁর উপর চাপানো হচ্ছে বলে তিনি অপমানিত বোধ করেন। শ্রীরামপুরের চারবারের সাংসদ বলেন, “দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) যখন বলেছেন যে সাংসদদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, তখন এর দায় আমার। তাই আমি সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, যে সাংসদরা নিয়মিত সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, অথচ তাঁকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁদের সাংসদ করেছেন, তাঁরা লোকসভায় আসেনই না। দক্ষিণ কলকাতা, ব্যারাকপুর, বাঁকুড়া, উত্তর কলকাতার সাংসদদের খুব কমই সংসদে দেখা যায়। আমার কী দোষ? সবকিছুর জন্য আমাকেই দায়ী করা হচ্ছে।”
২. মহুয়া-দ্বন্দ্বের জের
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ইস্তফার পেছনে কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সংঘাতকেও একটি বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ইস্তফার দিনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক শুরুর আগে মহুয়াকে দেখে তাঁর দিন খারাপ যাবে বলে কল্যাণ মন্তব্য করেন। বৈঠক শেষে তিনি জানান, দিনটি সত্যিই খারাপ গিয়েছে। এর আগে ইন্ডিয়া টুডের একটি পডকাস্টে মহুয়ার ‘ শুয়োর ‘ মন্তব্যের জেরে কল্যাণ তাঁকে ‘বড়লোকের বিটি লো’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। এই ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণের পরও দল নীরব থাকায় কল্যাণ গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন বলে জানান।
৩. অভিষেক-যুগের সূচনা: নতুন দলনেতা
অন্যদিকে, এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে লোকসভার নতুন দলনেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ডায়মন্ড হারবারের তিনবারের এই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থলাভিষিক্ত হলেন। সূত্র অনুযায়ী, কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে “শারীরিক অসুস্থতার” কারণে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, এই পরিবর্তন প্রবীণ নেতাদের প্রভাব কমিয়ে নবীন নেতৃত্বের হাতে দলের রাশ তুলে দেওয়ার একটি কৌশল।
মুখ্য সচেতক পদ ছাড়ার পর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কল্যাণকে ফোন করে আগামী ৭ই আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব সামলাতে বলেছেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি পদত্যাগ প্রত্যাহার করবেন কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
Mamata : দাঙ্গার দিনকে ‘শহিদ দিবস’ ঘোষণা নিয়ে বিজেপি বনাম মমতা !
৪. প্রবীণদের কোণঠাসা করার কৌশল?
লোকসভায় দলের বিরোধী দলনেতা এবং মুখ্য সচেতকের এই যুগপৎ পরিবর্তন থেকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এটি দলের মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনকে প্রবীণ নেতৃত্বের প্রভাব কমিয়ে “সংগ্রামী নবীন প্রজন্মের” হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পরিবার-কেন্দ্রিক শাসক দলের এই পরিবর্তন আগামী দিনের নির্বাচন এবং দুর্নীতির আইনি লড়াইয়ের দিকে লক্ষ্য রেখেই আনা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। এর আগে তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন সংসদে বারবার মুলতুবির জন্য সরকারকে দায়ী করে মন্তব্য করেছিলেন, যা দলের সংসদীয় কৌশলের একটি অংশ ছিল। নতুন নেতৃত্বের অধীনে এই কৌশল কীভাবে পরিবর্তিত হয়, এখন সেটাই দেখার।