malda ratha yatra controversy

সৌরভ রায় চৌধুরী , ১৯ জুলাই ২০২৫ : মালদা জেলার কালিয়াচক থানার অধীন জালালপুর গ্রামে শ্রী মহাপ্রভু মন্দির সংলগ্ন রথযাত্রা ও মেলা এই অঞ্চলের এক সুপ্রাচীন এবং অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য। এটি কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং ৬২৯ বছরের এক জীবন্ত ইতিহাস, যা রথযাত্রা এবং এক সপ্তাহ থেকে নয় দিনব্যাপী মেলা নিয়ে গঠিত। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের মতে, এই উৎসব মুঘল আমলেরও বহু আগে, অর্থাৎ প্রায় ১৪০০ শতকের শুরুতে প্রচলিত ছিল, যা এর গভীর ঐতিহাসিক শেকড় প্রমাণ করে।

এই প্রতিবেদন মালদা কালিয়াচকের জালালপুর রথ ও মেলার দীর্ঘকালীন ইতিহাস, এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব, স্থানীয় সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উদ্ভূত বিতর্কগুলিকে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশদভাবে তুলে ধরবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো এই প্রাচীন উৎসবের ধারাবাহিকতা, এটি যে সকল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে এবং সময়ের সাথে এর বিবর্তনের একটি সামগ্রিক চিত্র প্রদান করা।

১. ঐতিহাসিক উৎস ও প্রাচীনত্ব

জালালপুর রথযাত্রার ইতিহাস অন্তত ১৪০০ শতকের শুরুতে ফিরে যায়, যখন এই এলাকায় সনাতন ধর্মের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী, এই উৎসবটি মুঘল আমলেরও আগে থেকে চলে আসছিল, যা এর অভূতপূর্ব প্রাচীনত্বকে প্রমাণ করে। বেনীমাধবের পঞ্জিকাতেও এই জালালপুর রথযাত্রার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এর ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রাচীনত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। এটি কেবল একটি লোককথা নয়, বরং লিখিত ঐতিহ্যের অংশ।

প্রতিষ্ঠাতা বা পৃষ্ঠপোষকতার প্রাথমিক তথ্য: গবেষণা উপাদানগুলিতে জালালপুর রথযাত্রার কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠাতা বা আদি পৃষ্ঠপোষকের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তবে, এটিকে একটি “ঐতিহ্যবাহী” এবং “শতাব্দী ধরে চলে আসা” উৎসব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, এটি হয়তো স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ অথবা কোনো প্রাচীন রাজপরিবার বা জমিদার বাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়েছিল, যার সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক দলিল সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে। মালদা শহরের অন্যান্য রথযাত্রা, যেমন মকদুমপুরের রথ (১৮৪০ সালে ডাক্তার ঠাকুরদাস স্বপ্নাদেশ পেয়ে তৈরি করেছিলেন) বা বিশ্বাসবাড়ির রথ (প্রায় ৭০ বছর আগে কালীপদ বিশ্বাস কর্তৃক সূচিত হয়েছিল) সেগুলির প্রতিষ্ঠাতাদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। এর বিপরীতে জালালপুরের রথের প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট বিবরণের অনুপস্থিতি এর গভীর প্রাচীনত্বের একটি পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সময়ের সাথে রথযাত্রা ও মেলার বিবর্তন: জালালপুর রথযাত্রার বিবর্তনের বিস্তারিত তথ্য সীমিত হলেও, এটি স্পষ্ট যে জমির মালিকানা বিতর্ক, আইনি জটিলতা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রভাবের কারণে এই উৎসবটি বহু বছর ধরে বন্ধ ছিল। এই দীর্ঘ বিরতি উৎসবের ধারাবাহিকতায় একটি বড় ছেদ তৈরি করেছিল। ২০০৫ এবং ২০০৯ সালে রথযাত্রার সাথে সংযুক্ত মেলায় গুরুতর আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে, যার ফলে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটেছিল। এই গুরুতর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন মেলার উপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

এই পটভূমিতে, ২০২২ সালে কালিয়াচক থানার উদ্যোগে পুলিশের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা গড়ে ওঠে, যার ফলস্বরূপ রথযাত্রা পুনরায় শুরু হয়। তবে, এই সমঝোতার শর্ত ছিল যে জমির মালিকরা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য অনাপত্তি পত্র (NOC) প্রদান করবেন, কিন্তু বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুমতি দেবেন না। পুলিশের মতে, তাদের হস্তক্ষেপের ফলেই শান্তিপূর্ণভাবে রথযাত্রা পুনরায় শুরু হয়েছে এবং এটি প্রতি বছর নির্দিষ্ট পুলিশি নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

Puri Jagannath Dham : কেন শ্রীক্ষেত্র পুরীর বিকল্প সম্ভব নয় ? আধ্যাত্মিকতা এবং অদম্য প্রতিরোধের বহু শতাব্দীর ইতিহাস !

২. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য

মালদা কালিয়াচকের জালালপুর রথযাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রমাণ। এটি এলাকার মানুষের কাছে একটি গভীর আবেগ ও প্রত্যাশার উৎসব। রথের দড়িতে টান দেওয়ার অপেক্ষায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর একত্রিত হন, যা এই উৎসবের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভক্তি ও ভালোবাসাকে তুলে ধরে। এই সমাগম কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে নয়, বরং এটি একটি সামাজিক মিলনক্ষেত্র হিসেবেও কাজ করে।

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ: এই মেলায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি এর সর্বজনীন আবেদন এবং সামাজিক সংহতির প্রতীক। এটি প্রমাণ করে যে উৎসবটি কেবল একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সহাবস্থানকে উৎসাহিত করে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক পটভূমির মানুষ একসঙ্গে এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন, যা বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন: রথযাত্রার সাথে এক সপ্তাহ থেকে নয় দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিভিন্ন দোকানপাট, নানা রকম রাইড এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই মেলা শুধুমাত্র স্থানীয়দের জন্য নয়, অন্যান্য জেলা থেকেও হাজার হাজার মানুষ এই মেলায় আসেন, যা এর আঞ্চলিক গুরুত্ব এবং জনপ্রিয়তাকে প্রমাণ করে। এই ধরনের মেলাগুলি স্থানীয় সংস্কৃতি ও লোকশিল্পের প্রদর্শনী এবং প্রসারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

৩. সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব

মালদা কালিয়াচকের জালালপুর রথ মেলা স্থানীয় অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রথযাত্রা উৎসব কমিটির সম্পাদক গৌতম মণ্ডল এবং অন্যান্য উদ্যোক্তারা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই মেলা এলাকার অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেলা চলাকালীন দোকানপাট, বিভিন্ন ধরনের রাইড এবং বিনোদনমূলক আয়োজনকে কেন্দ্র করে প্রায় সাত থেকে নয় দিন ধরে একটি জমজমাট বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরি হয়। এই সময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হস্তশিল্পী এবং অস্থায়ী বিক্রেতারা তাদের পণ্য ও পরিষেবা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষের সমাগম এবং এর বাণিজ্যিক দিক: এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এই মেলায় মালদা জেলা ছাড়াও অন্যান্য জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। এই বিশাল জনসমাগম স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে একটি বড় বাণিজ্যিক প্রভাব ফেলে। পর্যটক ও দর্শনার্থীরা স্থানীয় পণ্য ক্রয় করেন, খাদ্যের দোকানে ভিড় করেন এবং বিভিন্ন রাইডে অংশ নেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধি করে।

উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে একটি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে যে, যদি এই উৎসব বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে দেবোত্তর জমিতে জমি মাফিয়ারা প্লট তৈরি করে তা বিক্রি করার চেষ্টা করবে। এই অভিযোগ মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি এর সাথে জড়িত জমির মূল্য এবং দখলদারির বিষয়টিকেও তুলে ধরে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মেলার বাণিজ্যিক দিকটি কেবল ক্ষুদ্র ব্যবসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সাথে বৃহত্তর ভূ-সম্পত্তিগত স্বার্থও জড়িত থাকতে পারে।

৪. চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক: একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মালদা কালিয়াচকের জালালপুর রথ ও মেলার দীর্ঘ ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে চ্যালেঞ্জ ও বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে, যা এর ধারাবাহিকতাকে প্রভাবিত করেছে। বর্তমান বিতর্কটি এই উৎসবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি পুনরাবৃত্তি মাত্র, যেখানে ঐতিহ্য, ধর্মীয় স্বাধীনতা, স্থানীয় অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থের জটিল সংঘাত স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।

জমির মালিকানা বিতর্ক ও আইনি জটিলতার কারণে অতীতে উৎসব বন্ধ থাকার ইতিহাস: জালালপুর রথযাত্রার ইতিহাস ১৪০০ শতকের শুরুতে ফিরে গেলেও, সময়ের সাথে সাথে জমির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়, যা এই উৎসবকে বহু বছর ধরে বন্ধের দিকে ঠেলে দেয়। জালালপুর রথ সংস্কার কমিটির সভাপতি বুদ্ধদেব ঘোষ এবং সম্পাদক গৌতম মন্ডলের নেতৃত্বে কমিটি এবং জমির মালিক শংকর প্রসাদ চৌধুরী (স্বর্গীয় ক্ষিতীশ চৌধুরীর পুত্র) এর মধ্যে এই বিতর্ক চলছিল। জমির ক্ষতি এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উপর আপত্তির কারণে মালিক পক্ষটি মেলা বা দোকানপাটের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। এই দীর্ঘস্থায়ী আইনি জটিলতা উৎসবের স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে।

২০০৫ ও ২০০৯ সালের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা এবং মেলার উপর নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপট: অতীতে, ২০০৫ এবং ২০০৯ সালে রথযাত্রার সাথে সংযুক্ত মেলায় গুরুতর আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটেছিল। এই ঘটনাগুলির পর প্রশাসন মেলার উপর পুরোপুরি নিষেধ আরোপ করে, যা উৎসবের বাণিজ্যিক অংশকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি বর্তমান বিতর্কের একটি ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেছে, যা প্রশাসনের বর্তমান সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

২০২২ সালে পুলিশের মধ্যস্থতায় রথযাত্রা পুনরায় শুরু হওয়া: এই জটিল পটভূমিতে, ২০২২ সালে কালিয়াচক থানার উদ্যোগে পুলিশের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এই সমঝোতার মাধ্যমে জমির মালিকরা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য একটি অনাপত্তি পত্র (NOC) দিয়ে সম্মতি জানান, কিন্তু বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুমতি প্রদান করেননি। পুলিশের মতে, তাদের হস্তক্ষেপের ফলেই শান্তিপূর্ণভাবে রথযাত্রা পুনরায় শুরু হয়েছে এবং এটি প্রতি বছর নির্দিষ্ট পুলিশি নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

২০২৫ সালের বর্তমান বিতর্ক: পুলিশি অনুমতির অস্বীকৃতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণ: ২০২৫ সালে এসে, ৬২৯ বছরের পুরনো এই রথযাত্রার মেলা আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে। পুলিশ-প্রশাসন মেলার অনুমতি দিতে নারাজ, যদিও রথযাত্রার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কাকে তাদের সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, বিশেষত মেলায় অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং খুনের ঘটনার কথা তুলে ধরেছে। উদ্যোক্তারা এই অভিযোগকে “ভিত্তিহীন” এবং “কালিমালিপ্ত” করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

জমি মাফিয়াদের জড়িত থাকার অভিযোগ এবং রাজনৈতিক বিতর্ক: রথযাত্রা উৎসব কমিটির সম্পাদক গৌতম মণ্ডল অভিযোগ করেছেন যে, উৎসব বন্ধ হয়ে গেলে দেবোত্তর জমি দখল করে জমি মাফিয়ারা প্লট তৈরি করবে এবং বিক্রি করবে। তিনি আরও দাবি করেন যে এই প্রাচীন মেলাটি “বিশেষ ভোটব্যাঙ্কের” জন্য বন্ধ করা হচ্ছে।

বিজেপি, বিশেষত মালদহ দক্ষিণ বিজেপির সাংগঠনিক সভাপতি অজয় গঙ্গোপাধ্যায় এবং রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, পুলিশের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের অভিযোগ, পুলিশ শাসকদলের তাঁবেদারি করছে এবং দেবোত্তর জমি দখল করতে জমি মাফিয়াদের সাহায্য করছে। তারা এটিকে হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে “জেহাদি তোষণ” এবং “উর্দুকরণ” নীতির অংশ হিসেবেও দেখছেন। অন্যদিকে, তৃণমূল নেতা কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী দাবি করেছেন যে, পুলিশ আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে মনে করেই অনুমতি দেয়নি, এবং এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

কলকাতা হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায় এবং প্রশাসনের অবস্থান: কলকাতা হাইকোর্টও সম্প্রতি প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে মেলার অনুমতি প্রদানের আবেদন খারিজ করেছেন। মালদা জেলা পুলিশ জানিয়েছে যে, জালালপুর রথযাত্রা নিয়ে কিছু ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়ানো হচ্ছে, যা বাণিজ্যিক স্বার্থে করা হতে পারে। পুলিশ আরও জানিয়েছে যে জমি এখনও আইনি বিবাদে জড়িত এবং এই মামলা আদালতে বিচারাধীন।

৫. মালদা কালিয়াচক রথ ও মেলার প্রধান ঐতিহাসিক মাইলফলক

 

মাইলফলকআনুমানিক সময়কাল/বছরবিবরণ
প্রতিষ্ঠা৬২৯ বছর পূর্বে (আনুমানিক ১৪০০ শতকের শুরুতে)মুঘল আমলেরও আগে এই রথযাত্রা ও মেলার প্রচলন ছিল। বেনীমাধবের পঞ্জিকাতেও উল্লেখ আছে।
আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা২০০৫, ২০০৯মেলায় গুরুতর আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে, যার ফলে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটেছিল।
মেলার উপর নিষেধাজ্ঞা২০০৫ ও ২০০৯ সালের ঘটনার পরপ্রশাসনের পক্ষ থেকে মেলার উপর পুরোপুরি নিষেধ আরোপ করা হয়।
দীর্ঘকালীন বন্ধ থাকাবহু বছর (২০০৯ সালের পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত)জমির মালিকানার বিতর্ক, আইনি জটিলতা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রভাবে উৎসবটি বন্ধ ছিল।
পুনরায় চালু হওয়া২০২২কালিয়াচক থানার উদ্যোগে পুলিশের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা গড়ে ওঠার পর রথযাত্রা পুনরায় শুরু হয়। জমির মালিকরা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অনুমতি দেন।
বর্তমান বিতর্ক২০২৫পুলিশ মেলার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা এবং জমি মাফিয়াদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। কলকাতা হাইকোর্ট মেলার অনুমতি খারিজ করে।

৬. পশ্চিমবঙ্গের কিছু প্রাচীন রথযাত্রার তুলনামূলক চিত্র

মালদা কালিয়াচকের জালালপুর রথযাত্রার ৬২৯ বছরের প্রাচীনত্ব এটিকে বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রাগুলির মধ্যে অন্যতম করে তোলে, যা মাহেশ রথযাত্রার সমতুল্য।

রথযাত্রার নামআনুমানিক বয়স / প্রতিষ্ঠার বছরপ্রতিষ্ঠাতা/বিশেষত্ব
মালদা কালিয়াচক (জালালপুর)৬২৯ বছর পূর্বে (আনুমানিক ১৪০০ শতকের শুরুতে)মুঘল আমলেরও আগে থেকে প্রচলিত, বেনীমাধবের পঞ্জিকাতে উল্লেখ আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জমি বিতর্ক ও আইনশৃঙ্খলাজনিত কারণে মেলা বন্ধের চেষ্টা।
মাহেশ (শ্রীরামপুর, হুগলী)১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ (৬২৯ বছর)বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা। ৫০ ফুট উঁচু, ১২৫ টন ওজনের রথ। নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে যাওয়ার পর রথ টানা হয়।
গুপ্তিপাড়া (হুগলী)১৭৪০ খ্রিস্টাব্দ (২৮৫ বছর)মধুসূদানন্দ কর্তৃক সূচিত। ‘বৃন্দাবন জিউর রথ’ নামে পরিচিত।
মহিষাদল (পূর্ব মেদিনীপুর)১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ (২৪৯ বছর)জমিদার আনন্দলালের স্ত্রী জানকী দেবী কর্তৃক সূচিত।
বিষ্ণুপুর (বাঁকুড়া)১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ (৩৫০ বছর)মল্লরাজা বীরহাম্বির রানি শিরোমণি দেবীর ইচ্ছায় রাধামদন গোপাল জিউর জন্য নির্মিত। জগন্নাথের পরিবর্তে রাধামদন গোপাল জিউকে রথে বসানো হয়।
আমরাগড়ি রায়বাড়ি (হাওড়া)৩০৩ বছর পেরিয়ে ৩০৪ বছরে পদার্পণগ্রামীণ হাওড়ার শতাব্দী প্রাচীন রথযাত্রা উৎসব।
উখড়ার জমিদার বাড়ি১৭৮ বছর পূর্বেশম্ভুলাল সিংহ হাণ্ডা কর্তৃক সূচিত। রথে গোপীনাথ ও শ্রীরাধা অধিষ্ঠিত।
মকদুমপুর (মালদা শহর)১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ (প্রায় ১৮৫ বছর)ডাক্তার ঠাকুরদাস স্বপ্নাদেশ পেয়ে তৈরি করেন। ব্রজমোহন ও রাধারানি রথে চড়েন।
বিশ্বাসবাড়ি (মালদা)প্রায় ৭০ বছর পূর্বেকালীপদ বিশ্বাস কর্তৃক সূচিত।

৭. উপসংহার: ঐতিহ্য বনাম আধুনিক চ্যালেঞ্জ

মালদা কালিয়াচকের রথ ও মেলা কেবল একটি প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি একটি জটিল ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সত্তা। এর দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য এবং বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলি ঐতিহ্য সংরক্ষণ, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকার এবং প্রশাসনের ভূমিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্বকে তুলে ধরে। রাজনৈতিক অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগগুলি এই বিতর্কের জটিলতা আরও বাড়িয়েছে, যা ঐতিহ্য সংরক্ষণের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে।

কলকাতা হাইকোর্টের রায় মেলা বন্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও, স্থানীয় মানুষের আবেগ এবং উৎসবের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। জমি দখলের অভিযোগ এবং ‘ভোটব্যাঙ্ক’ রাজনীতির প্রসঙ্গ ইঙ্গিত দেয় যে এই ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উৎসবটি এখন একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খেলার অংশ হয়ে উঠেছে। দেবোত্তর জমির মালিকানা এবং এর ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিনের আইনি বিরোধ এই সংঘাতকে আরও জটিল করেছে। এই পরিস্থিতি ঐতিহ্যবাহী উৎসবের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করে এবং এই উৎসবের ভবিষ্যৎ কেবল আইনি রায় বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এর সাথে জড়িত সকল পক্ষের সহযোগিতা এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানের উপরও নির্ভর করে।

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর

বিশ্ব জুড়ে

গুরুত্বপূর্ণ খবর