ব্যুরো নিউজ ১১ জুন : প্রায় এক দশক বিলম্বের পর অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বহু প্রতীক্ষিত বেড়া নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে শুরু করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে। আট বছর আগে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হওয়া এবং কেন্দ্র কর্তৃক কোটি কোটি টাকা ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও, ২৩.৭ কিলোমিটার সীমান্তের বড় অংশ এখনও অসুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে এই অঞ্চল অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, জাল নোটের প্রচলন এবং অবৈধ অভিবাসনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তাহীনতা ও দীর্ঘসূত্রিতা
তেহট্ট, করিমপুর, কৃষ্ণগঞ্জ, হাঁসখালি এবং রানাঘাটের মতো সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা নিরন্তর আতঙ্কে জীবনযাপন করছেন, যেখানে নিরাপত্তা ঝুঁকির উদ্বেগ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ এবং বিএসএফ-এর কাছে তা হস্তান্তরে বিলম্বের কারণে বেড়া নির্মাণ প্রকল্প দীর্ঘকাল ধরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ধীর গতির শিকার হয়েছে। বর্তমানে, নদিয়ায় প্রায় ২৩.৭ কিলোমিটার অরক্ষিত আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে ১৩.৫ কিলোমিটার নদীপথ এবং ১০.২ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত। এই অঞ্চলগুলি বিশেষ করে আন্তঃসীমান্ত অনুপ্রবেশ, জাল নোটের প্রচলন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সহ অবৈধ অভিবাসন এবং মাদক ও অস্ত্রের চোরাচালানের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ভূমি অধিগ্রহণে অগ্রগতি
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বেড়া নির্মাণ প্রকল্পের জন্য জমি কেনার কাজ ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। বস্তুত, চাপড়া ব্লকের মহাকোলা এবং রাঙ্গিয়াপোতা মৌজাগুলিতে ২৩.৭৯ একর জমি ইতিমধ্যে ১০.৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে অধিগ্রহণ করে বিএসএফ-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই এলাকার জন্য মোট ১৪.১৭ কোটি টাকা ৩০.৮৬ একর জমির জন্য অনুমোদিত হয়েছিল। করিমপুরের বড়োইপাড়া, দাহখোলা এবং গান্ধীনা মৌজাগুলিতে প্রয়োজনীয় ৫.২৪ একরের মধ্যে ৪.৯৩ একর জমি ৮.৭৭ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে। একইভাবে, রানাঘাটের বনবেরিয়া, শ্রীরামপুর এবং কালুপুরে ৩৬.৩৭ একরের মধ্যে ৯.৪ একর জমি ১৬.৫৫ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে, যখন কৃষ্ণগঞ্জের বিজয়পুর এবং গেদেতে প্রয়োজনীয় ২৩.০৪ একরের মধ্যে ১৮.২২ একর জমি ১৩.২০ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে।
ভূমি হস্তান্তর সত্ত্বেও কাজের অনুপস্থিতি ও স্থানীয় অসন্তোষ
যদিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএসএফ-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, তবে বেড়া নির্মাণের কাজ এখনও মাঠ পর্যায়ে সেভাবে শুরু হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উভয়ই এর সমালোচনা করেছেন। মহাকোলার এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করছি। জমি কেনা হয়েছে, টাকা খরচ হয়েছে, অথচ বেড়া নেই। আমাদের গ্রামগুলো নিরাপদ নয়।” তেহট্ট এবং কৃষ্ণগঞ্জেও একই ধরনের উদ্বেগ শোনা যাচ্ছে, যেখানে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা বাড়ছে।
অনুপ্রবেশের উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
রানাঘাট পুলিশ জেলা সূত্র অনুযায়ী, গত কয়েক মাসেই ২০০ টিরও বেশি অনুপ্রবেশের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলায়, যা একসময় তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত বলে বিবেচিত হত, সেখানেও অবৈধ অতিক্রমণের নতুন লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
প্রশাসনিক জটিলতা এবং বিএসএফ-এর বক্তব্য
বিএসএফ কর্মকর্তারা জরুরি অবস্থা স্বীকার করেছেন কিন্তু প্রক্রিয়াগত বাধাগুলির কথা উল্লেখ করেছেন। বিএসএফ-এর একটি সূত্র জানিয়েছে, “কিছু জমি এখনও অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। একবার সেটি সম্পন্ন হলে, বেড়া নির্মাণের কাজ পূর্ণ গতিতে শুরু হবে।” বিএসএফ দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের জনসংযোগ আধিকারিক এন কে পান্ডে বলেছেন: “কাজ শুরু হয়েছে এবং এটি এগিয়ে চলেছে। এটি সময়ের ব্যাপার। খুব শীঘ্রই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। কোনো সমস্যা নেই।”
রাজ্য সরকারের ভূমিকা এবং দীর্ঘদিনের বাধা
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্যের সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে বিএসএফ-এর টহলদারি এলাকা সম্প্রসারণের বিষয়ে কঠোর বিরোধিতা সীমান্ত চৌকি নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় বেড়া স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা ছিল। বিশেষ করে জলসীমা ও জলাভূমিতে আউটপোস্ট নির্মাণে এই বিরোধিতা একটি দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের সহযোগিতা এই দীর্ঘদিনের জট কাটাতে সাহায্য করবে বলে প্রত্যাশা ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও স্থানীয়দের সংশয়
এদিকে, জমি ক্রয় কমিটি হাঁসখালি ব্লকের প্রায় ২০০ জন জমি মালিককে নোটিশ জারি করেছে, যা আরও অধিগ্রহণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কর্মকর্তারা মনে করছেন, কেন্দ্রের বর্তমান গতি ইন্দো-বাংলা সীমান্তের এই অরক্ষিত অংশকে সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে আরও গুরুতর উদ্দেশ্যকে তুলে ধরে। তবুও, মাঠ পর্যায়ে স্থানীয়দের মধ্যে সংশয় রয়ে গেছে। অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং কাঁটাতারবিহীন নদীর তীরে উত্তেজনা বাড়ায়, বাসিন্দারা রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয় সরকারকেই এই বিষয়টিকে এর প্রাপ্য গুরুত্ব সহকারে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন।