ব্যুরো নিউজ ১১ জুন : অসমে ‘অবৈধ অভিবাসী’ চিহ্নিতকরণ এবং বিতাড়নের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের (FT) দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে এবার সরাসরি প্রশাসনিক পদক্ষেপের ঘোষণা করেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ১৯৫০ সালের ‘ইমিগ্র্যান্টস (এক্সপালশন ফ্রম আসাম) নির্দেশ’ অনুযায়ী জেলা প্রশাসন এখন থেকে নিজেই বিদেশিদের বিতাড়িত করতে পারবে। অর্থাৎ, যদি কোনো মামলা কোর্টে ঝুলে না থাকে, তাহলে সরাসরি ‘পুশব্যাক’ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত ৭৪ বছরের পুরনো একটি আইনকে কেন হঠাৎ করে হাতিয়ার করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
৭৪ বছরের পুরনো আইন কেন হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ?
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার দাবি, সুপ্রিম কোর্ট 6A ক্লজ মামলার শুনানিতে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে ১৯৫০ সালের নির্দেশটি এখনও বলবৎ রয়েছে। তাঁর মতে, এতদিন আইনজীবীরা এই বিষয়টি তুলে ধরেননি বলেই সরকার এ বিষয়ে অবগত ছিল না। তবে সমালোচকরা বলছেন, এনআরসি (NRC) জটিলতায় কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ই যখন ‘ব্যাকফুটে’, তখন বিজেপি সরকার এই পুরনো আইনকে সামনে এনে দ্রুত পদক্ষেপ দেখাতে চাইছে। এনআরসি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পর, ‘অবৈধ অভিবাসী’ ইস্যুটি বিজেপি-র জন্য একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই রয়ে গেছে।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
বাংলাদেশ কি সরাসরি নিশানায়?
অসমে ‘বিদেশি’ বলতে মূলত যাদের বোঝানো হয়, তাদের একটি বড় অংশকে ‘বাংলাদেশি মুসলমান’ হিসেবে বিজেপি প্রচার করে থাকে। এনআরসি প্রকাশের সময় থেকেই এই ধরনের প্রচার চলে আসছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত নিজেও একাধিকবার বলেছেন, “অসমে অনুপ্রবেশ করে জনসংখ্যার ভারসাম্য বদলে দেওয়া হচ্ছে।” যদিও ১৯৭১ সালের আগে যারা এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব সংরক্ষিত, বিজেপির রাজনৈতিক বক্তব্য অনুযায়ী, তারপরও প্রচুর বাংলাদেশি মুসলমান অসমে ঢুকেছেন। এনআরসি-তে নাম বাদ যাওয়া ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিল মুসলমান—এই নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। তাই ১৯৫০ সালের আইন প্রয়োগ করে প্রশাসনের হাতে সরাসরি ‘ডিপোর্ট’ করার ক্ষমতা তুলে দিলে, কার্যত সেই তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশিরাই’ নিশানায় পড়বেন—বিশেষ করে যারা এখনও আদালতের আওতায় আসেননি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলির আপত্তি
হিমন্ত বিশ্বশর্মার এই সিদ্ধান্ত ঘিরে মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে তীব্র আপত্তি দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, একজন নাগরিককে ‘বিদেশি’ বলে চিহ্নিত করা এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠানো একটি গভীর আইনি সিদ্ধান্ত। আদালতের পর্যালোচনা ছাড়া প্রশাসনের হাতে এই ধরনের ক্ষমতা থাকা সংবিধানবিরোধী। মানবাধিকার কর্মীরা আরও আশঙ্কা করছেন যে, এই ক্ষমতা প্রয়োগে জাতিগত ও ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা প্রবল। বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৫০ সালের আদেশটি দেশভাগ-পরবর্তী বাস্তবতার জন্য তৈরি হয়েছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এটির ব্যবহার আবার প্রয়োজনীয়তা অর্জন করেছে ।
প্রবীণ নাগরিকদের জন্য কেন্দ্রের ঐতিহাসিক ঘোষণা: ১৫ জুন থেকে সারাদেশে বিনামূল্যে ভ্রমণের সুবিধা
এনআরসি ব্যর্থতার বিকল্প পথ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি
২০১৯ সালে এনআরসি প্রকাশিত হলেও, সরকার নিজেই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয়, বহু হিন্দু অভিবাসীর নামও বাদ পড়েছিল, যা বিজেপি-র জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। তাই এনআরসি প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত। অন্যদিকে, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের (FT) মাধ্যমে বিচারের গতি এত ধীর যে, বহু মামলার নিষ্পত্তি এখনও বাকি। তাই মুখ্যমন্ত্রী এখন সরাসরি প্রশাসনিক আদেশে কাজ সারতে চাইছেন।
এই পদক্ষেপের প্রভাব ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও পড়তে পারে। যদিও সরকার স্পষ্ট করেনি যে ‘পুশব্যাক’ হলে তা ভারতের সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠানো হবে, তবে তা পরোক্ষভাবে বোঝানো হচ্ছে। আর এটাই ঢাকার পক্ষে উদ্বেগের কারণ। কারণ, অতীতে এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশ স্পষ্ট জানিয়েছিল যে, তারা কোনো ‘অবৈধ অভিবাসী’কে ফেরত নেবে না। এই পদক্ষেপ আইনি দিক থেকে যুক্তিযুক্ত হওয়ার কারণে অসম সরকারের এই পদক্ষেপ প্রশাসনিক ভাবে দ্রুত কারজকরি হতে চলেছে ।