শুদ্ধাত্মা মুখার্জি , ২৯অক্টোবর ২০২৫ : ভারতের জন্য এক সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে, প্রায় ২৫ বছরের সামরিক উপস্থিতির পর তাজিকিস্তানের আইনি বিমানঘাঁটি (Ayni Airbase) থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনী (IAF) তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এই বিমানঘাঁটি পাকিস্তানের নৈকট্যে অবস্থিত এবং এই অঞ্চলে ভারতের সামরিক কার্যকলাপের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। সুখোই যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে উপস্থিতি বজায় রাখার প্রস্তাব দিলেও, তাজিকিস্তানের সঙ্গে এই বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি।
আইনিতে কেন ছিল ভারতের উপস্থিতি?
ভারত ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধের সময় তাজিকিস্তানের সাথে সামরিক সহযোগিতা শুরু করে। সেই সময়ে ভারত তালেবানের বিরুদ্ধে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে (Northern Alliance) সমর্থন করত। আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী তাজিকিস্তান রসদ সরবরাহ, গোয়েন্দা সহযোগিতা এবং মানবিক সহায়তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হয়ে ওঠে।
- সূচনা: কোনো আনুষ্ঠানিক সামরিক ঘাঁটি না থাকা সত্ত্বেও, ভারত এই অঞ্চলে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করার জন্য তাজিকিস্তানের সুবিধাগুলি ব্যবহার করতে শুরু করে। ভারতীয় চিকিৎসা ও কারিগরি দল সেখানে সক্রিয় ছিল।
- ফারখোর ও আইনি উন্নয়ন: ২০০২ সালে, ভারত তাজিকিস্তানের সাথে একটি চুক্তি চূড়ান্ত করে, যার মাধ্যমে ভারতকে ফারখোর বিমানঘাঁটি (Farkhor Air base) সংস্কার এবং ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। এটি ছিল ভারতের প্রথম বিদেশের সামরিক ঘাঁটি। ভারত আইনি এবং ফারখোর উভয় ঘাঁটিরই রানওয়ে সম্প্রসারণ, হ্যাঙ্গার নির্মাণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অর্থ বিনিয়োগ করে।
- আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন: ভারতের অর্থায়নে বড় ধরনের সংস্কারের পর ২০১০ সালে আইনি বিমানঘাঁটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। তাজিকিস্তান সার্বভৌমত্ব বজায় রাখলেও, ভারত যৌথ ব্যবহারের সাথে এই ঘাঁটিতে প্রবেশের অধিকার লাভ করে।
Afghanistan : পাকিস্তানের প্রভাবমুক্ত হওয়ার ইঙ্গিত? দেওবন্দ মাদ্রাসায় আফগান বিদেশমন্ত্রীর সফর, জাভেদ আখতারের তীব্র নিন্দা
কৌশলগত গুরুত্ব
এই ঘাঁটিগুলি ভারত ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে লজিস্টিক এবং প্রশিক্ষণের সংযোগ হিসেবে কাজ করত।
- আঞ্চলিক সুবিধা: পাকিস্তান স্থলপথে প্রবেশাধিকার রোধ করায়, এই বিমানঘাঁটিগুলি মধ্য এশিয়ায় ভারতের সরাসরি কৌশলগত উপস্থিতি নিশ্চিত করত।
- নজরদারি ও প্রতিক্রিয়া: এই অবস্থান ভারতকে পাকিস্তানের উত্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুবিধা প্রদান করত, যার ফলে বৃহত্তর অঞ্চলে নজরদারি এবং সম্ভাব্য দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা বজায় রাখা যেত।
তাজিকিস্তান ও রাশিয়ার সাথে অংশীদারিত্ব
এই বিমানঘাঁটির উন্নয়ন তাজিকিস্তানের সাথে ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছিল। রাশিয়াও আইনি ঘাঁটিতে সহযোগিতা করে, যা ভারত ও রাশিয়ার স্বার্থের সমন্বয়ের একটি স্থান ছিল। আইনি থেকে প্রত্যাহার করা হলেও, ফারখোর এখনো তাজিকিস্তানে ভারতের একমাত্র বিমানঘাঁটি হিসেবে বিদ্যমান। এই ঘাঁটি প্রশিক্ষণ, লজিস্টিক এবং কূটনৈতিক সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে।
Afghanistan : ভারতের বিরুদ্ধে আফগান ভূমি ব্যবহার করতে দেবে না কাবুল: নয়াদিল্লিতে বৈঠক শেষে জানালেন তালিবান মন্ত্রী !
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট: আফগানিস্তানে উপস্থিতি
আইনি থেকে ভারতের এই প্রত্যাহার এমন এক সময়ে ঘটল যখন আফগানিস্তানের বর্তমান তালেবান সরকার সেখানকার জনগণের উন্নয়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণে ভারতের সহযোগিতা চাইছে।
- বাগরামের সম্ভাবনা: বিভিন্ন সুত্রের অনুযায়ী, আফগানিস্তান নিজস্ব প্রয়োজনে ভারতের জন্য বাগরাম বিমানঘাঁটি (Bagram Air base) ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এই প্রয়োজনগুলির মধ্যে রয়েছে অসামরিক ও গ্রামীণ উন্নয়নে চিকিৎসা ও কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং আফগান জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাহায্য ও প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা।
- কৌশলগত পুনর্বিন্যাস: আইনি থেকে প্রত্যাহার তাই কোনো ‘পিছু হটা’ নয়, বরং এটিকে একটি সুচিন্তিত কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাজিকিস্তানে দুটি ঘাঁটি রাখার অতিরিক্ত কোনো কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু বাগরামে উপস্থিতি ভারতকে মধ্য এশীয় অঞ্চলের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশের কাছাকাছি তার কৌশলগত উপস্থিতি জোরদার করতে সাহায্য করবে।
- নিরাপত্তা উদ্বেগ: ভারত তার সমস্ত কৌশলগত অংশীদারদের নিরাপত্তা উদ্বেগের প্রতিও সজাগ। আইনি ও ফারখোর থেকে ভারত সমর্থিত নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে তালেবানের বিরুদ্ধে শত্রুতা বজায় রাখতে দেওয়া সম্ভব নয়, যদি ভারত বাগরাম থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়।
সবকিছু বিবেচনা করে, আইনি থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কার্যক্রমের সমাপ্তি এক কৌশলগত চাল (strategic move) ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাজিকিস্তানে ভারত এখনও ফারখোর বিমানঘাঁটি পরিচালনা করে যাচ্ছে এবং আফঘানিস্তানে বাগ্রাম বিমানঘাঁটি পরিচালনার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ।



















