ব্যুরো নিউজ ৫ জুন : আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, যে শিশু কথা বলতে পারে না, শুনতে পায় না বা অন্যদের মতো শিখতে পারে না, সে কি অন্যদের মতো একই ভালোবাসা, অধিকার এবং সুযোগ পায়? এই গভীর ভাবনা থেকেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সরকার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের (CWSN) জন্য রাজ্য জুড়ে এক বিশাল অভিযান শুরু করেছে। বেসিক এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিনব উদ্যোগে ১৫.৯ লক্ষেরও বেশি পোস্টার বিতরণ করা হচ্ছে, যেখানে এই শিশুদের অধিকার এবং সমাজের তাদের প্রতি সঠিক সহায়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সামাজিক সংযোগ কার্যক্রমও এই অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পোস্টার অভিযান: ব্যাপ্তি ও বার্তার গভীরতা
এই অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে উত্তরপ্রদেশের ৭৫টি জেলার প্রতিটি প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পঞ্চায়েত ভবন, কমিউনিটি হেলথ সেন্টার (CHC)/প্রাইমারি হেলথ সেন্টার (PHC), শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র এবং আশা কেন্দ্রে এই বিশেষ পোস্টারগুলি টাঙানো হয়েছে। মোট ১,৩২,৭১৬টি সরকারি ও সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে এই পোস্টারগুলি বিতরণ করা হচ্ছে। প্রতিটি বিদ্যালয় ছয়টি পোস্টারের একটি সেট পেয়েছে, যার প্রতিটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা এবং অক্ষমতার প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়াতে ইতিবাচক বার্তা বহন করছে।
সরকারি কর্মকর্তারা বুধবার জানিয়েছেন, এই পোস্টারগুলির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এগুলির আবেগপ্রবণ, সহজ এবং বাস্তবসম্মত আবেদন। এগুলি কেবল তথ্য সরবরাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এগুলি মানুষের মধ্যে আত্মচিন্তা জাগিয়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, একটি পোস্টার প্রশ্ন করে, ‘যে শিশুটি কথা বলতে পারে না কিন্তু শুনতে পায় — আপনি কি কখনও তাদের চোখে বিশ্বাস দেখেছেন?’ এর স্পষ্ট বার্তা হলো: অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কেবল অক্ষম শিশুদের জন্য নয়; এটি সমগ্র সমাজের ভবিষ্যৎকে শক্তিশালী করে তোলে। এই পোস্টারগুলি আলতোভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যদিও প্রতিটি শিশুই বিশেষ, তবে কিছু শিশুকে একটু বেশি করে বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত: ছাড়াল জাপানকে
নিরাপদ স্পর্শ ও সচেতনতা: শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এর মূলোৎপাটন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। ‘প্রতিটি শিশুই বিশেষ’ (‘Every Child is Special’) উদ্যোগের মূল ভিত্তিই হলো শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ করা। এই অভিযানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘নিরাপদ এবং অনিরাপদ স্পর্শ’ (safe and unsafe touch) সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। পোস্টারগুলির ২,৬৫,৪৩২টি সেট, যার প্রতিটিতে ছয় ধরনের পোস্টার রয়েছে, তা সংবেদনশীলতা, আত্মরক্ষা এবং আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে সাহায্য করছে। এই পোস্টারগুলি কেবল স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নেই; এগুলি কাউন্সিল-চালিত প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, কম্পোজিট স্কুল এবং কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে টাঙানো হচ্ছে। পাশাপাশি, পঞ্চায়েত ভবন, PHC/CHC, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং অন্যান্য জনসমক্ষেও এগুলি টাঙানো হচ্ছে, যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি সমাজের সকল স্তরে পৌঁছাতে পারে — কারণ একটি নিরাপদ শৈশবই একটি শক্তিশালী এবং ক্ষমতায়িত ভবিষ্যতের ভিত্তি।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা: নীতি ও বাস্তবায়ন
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো নিশ্চিত করা যে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা তাদের সমবয়সীদের মতোই একই পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করবে, যা তাদের সামগ্রিক বিকাশে সহায়তা করবে। এই শিক্ষণ মডেল অক্ষমতাকে কেবল একটি সীমাবদ্ধতা হিসেবে নয়, বরং সামাজিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের একটি রূপ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সহনশীলতা এবং বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করা হয়। উত্তরপ্রদেশ সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাকে তাদের শিক্ষা নীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে, যার ফলস্বরূপ রাজ্যের ৩ লক্ষেরও বেশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বর্তমানে উন্নত শিক্ষা লাভ করছে। এই উদ্যোগ শিক্ষা খাতে চলমান বিস্তৃত সংস্কারেরই একটি প্রতিফলন।
ইউনিসেফের সহযোগিতা ও মানসিকতার পরিবর্তন
ইউনিসেফের সহযোগিতায়, এই পোস্টারগুলি বিদ্যালয়গুলিতে অক্ষমতার প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংবেদনশীলতা প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি কেবল এই শিশুদের অধিকারই রক্ষা করে না, বরং সমাজে সমতা ও অন্তর্ভুক্তির মনোভাবকেও শক্তিশালী করে। উত্তরপ্রদেশের প্রাথমিক শিক্ষামন্ত্রী সন্দীপ সিং এই উদ্যোগ সম্পর্কে বলেছেন, “আমরা শুধু বিদ্যালয়গুলিতে বেঞ্চের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলছি না; আমরা দিগন্ত প্রসারিত করার কথা বলছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কেবল শিশুদেরই নয়, সমগ্র সমাজকে উন্নত করে। সম্ভবত এই প্রথম, একটি সরকার পোস্টারগুলিকে কেবল তথ্যের উপকরণ হিসেবে নয়, সংবেদনশীলতা এবং সংলাপের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি এমন একটি প্রচেষ্টা যা বাজেট, টেন্ডার বা প্রকল্পের ঊর্ধ্বে — এর মানসিকতা পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে। সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তি কেবল নীতিতেই নয়, দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখা যায়।” এই উদ্যোগটি উত্তরপ্রদেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতি সমাজের মনোভাব পরিবর্তন এবং তাদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।