মিঠুন ভট্টাচার্য, ৮ আগস্ট ২০২৫ : আজ ৮ই আগস্ট ২০২৫, গত বছর এই দিনে প্রয়াত হন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন এবং অন্যতম প্রগতিশীল মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ করা যাক এমন এক ব্যক্তিত্বকে , যিনি সহজ-সরল জীবনযাপন ও গভীর সাংস্কৃতিক অনুরাগের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও তিনি ব্যক্তিগত বিলাসিতা তথা ক্ষমতার অপব্যাবহার থেকে দূরে থাকতেন এবং তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে এক মুহূর্তের জন্যও ত্যাগ করেননি।
একজন আদর্শবাদী ও সংস্কৃতিমনা মানুষ
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন লেখক, নাট্যকার এবং আবৃত্তিকার। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তাঁর শাসনকালে তিনি কলকাতার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘নন্দন’-এর প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলা চলচ্চিত্র, নাটক ও সাহিত্যকে উৎসাহিত করেন। একজন কমিউনিস্ট নেতা হয়েও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধাবোধ তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভা এবং সাংস্কৃতিক মনন চিরকাল অনুপ্রেরণা জোগাবে।
Manifesto : ‘ইশতেহার’ ভাষার উৎস, ব্যুৎপত্তি এবং বাংলায় ব্যবহারের ইতিহাস
নতুন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক দর্শন ছিল মূলত পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণ। তিনি মনে করতেন, রাজ্যের উন্নতির জন্য শিল্পায়ন অপরিহার্য। তাঁর এই দূরদর্শী নীতি অনুযায়ী, তিনি তথ্যপ্রযুক্তি (IT) শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এবং সল্ট লেকের সেক্টর-ফাইভে একটি আইটি হাব গড়ে তোলেন, যা হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। টাটাদের মতো বড় শিল্পগোষ্ঠীকে রাজ্যে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি এক নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত খোলার চেষ্টা করেছিলেন। তার এই প্রগতিশীল মানসিকতা তাকে দলের মধ্যে একঘর করেছিল তার শাসনকালের শেষের দিকে , তার আপোষহীন চেতনা আর বাম আদর্শের মেল বন্ধন ঘটতে পারেনি । যার ফলে তার বাংলা কে নিয়ে স্বপ্ন অধরা থেকে যায় , এবং আজও এই গোটা বঙ্গের কাছে শিল্পায়নের স্বপ্ন অধরা ! আজও তার বক্তব্য ‘ চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকবনা ‘ তার সাথে বামফ্রন্ট সরকারের মত পার্থক্য মনে করিয়ে দেয় !
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিতর্ক তাঁর সরকারের পতনের কারণ হলেও, রাজ্যের শিল্পায়নের জন্য তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Lal Salam : ‘সালাম’ ও ‘সেলাম’ এর ইতিহাস এবং বামপন্থী সংস্কৃতিতে এর ব্যবহার
গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী এক কমিউনিস্ট
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী হলেও ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি প্রগতিশীলতায় বিশ্বাস করতেন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করেছেন। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে বুদ্ধবাবু একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি ‘অবৈধ মাদ্রাসা‘ বন্ধ করে দেবেন, কারণ সেগুলি ইসলামিক সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে এবং এই সমগ্র প্রকল্পের পেছনে আইএসআই-এর মদত রয়েছে। যদিও তার বামপন্থী দল তার ওপর প্রচণ্ড সৃষ্টি করে এইধরনের সত্য কে তুলে ধরার জন্যে ! আজ তার ফল টের পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ প্রতিমুহূর্তে ।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে গোটা দেশ এই প্রগতিশীল মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মানিত করার জন্য মনোনীত করেছিল। কিন্তু তাঁর কমিউনিস্ট আদর্শ শেষ বয়সেও তাঁকে ভারতবর্ষের অন্যতম সর্বোচ্চ উপাধি ‘পদ্মভূষণ’ প্রাপ্তি থেকে বিরত রাখে।
আজকের এই দিনে, সেই সৎসাহসী ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করা হল , যিনি তাঁর আদর্শ, নিষ্ঠা এবং সাংস্কৃতিক মননের জন্য ইতিহাসে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাঁর জীবন কঠিন পরিস্থতির মধ্যেও শেখায়, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি কীভাবে একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।