ব্যুরো নিউজ ০৬ অক্টোবর ২০২৫ : পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে রবিবার হামলার শিকার হলেন মালদহ উত্তরের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু এবং শিলিগুড়ির বিধায়ক তথা দলের মুখ্য সচেতক ড. শঙ্কর ঘোষ। জানা গেছে, ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের সময় তাঁদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয় এবং প্রায় ৫০০ জনের একটি জনতা লাঠি ও পাথর নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এই ঘটনায় সাংসদ খগেন মুর্মু গুরুতর আহত হয়েছেন এবং দু’জনকেই শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
হামলার বিবরণ ও বিজেপির অভিযোগ
বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের দাবি, দুপুর ১টা নাগাদ এই ঘটনা ঘটে। বন্যা এবং প্রবল বৃষ্টির কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি দেখতে তাঁরা গাড়ি থেকে নেমে এলাকায় হাঁটছিলেন, তখনই ভিড় তাঁদের ঘিরে ধরে এবং সাংসদ মুর্মুর ওপর হামলা শুরু করে।
শঙ্কর ঘোষ জানান, হঠাৎ কিছু লোক তাঁদের কাছে এসে বলে যে তারা “দিদির সৈনিক” এবং কেন বিজেপি নেতারা সেখানে এসেছেন। এর উত্তরে তাঁরা নিজেদের “মোদীজির সৈনিক” বলে পরিচয় দেন। এর পরেই জনতা তাঁদের ওপর আক্রমণ করে। ঘোষের অভিযোগ, “গাড়ির কিছুই অবশিষ্ট নেই, আমার সারা শরীর কাঁচে ঢাকা এবং মুর্মু হাসপাতালে ভর্তি।” মুর্মুর নিরাপত্তারক্ষীরা দ্রুত হস্তক্ষেপ করে দুই নেতাকে গাড়িতে তোলার পরই জনতা “বিজেপি দূর হটাও” স্লোগান দিয়ে গাড়িতে পাথর, লাঠি এবং জুতো ছুঁড়তে থাকে, যার ফলে গাড়ির কাঁচ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়।
এই ঘটনার জন্য রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেসকে দায়ী করেছে এবং এই হামলার প্রতিবাদে কলকাতায় বিক্ষোভ মিছিল করার পরিকল্পনা করছে।
শুভেন্দু অধিকারী ও সুকান্ত মজুমদারের তীব্র প্রতিক্রিয়া
রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ‘এক্স’-এ (X) পোস্ট করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন:
“মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চরম আতঙ্কিত। তিনি দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছেন যে উত্তরবঙ্গ যখন বন্যা ও ভূমিধসে ডুবে ছিল, বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছিলেন এবং হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়হীন ছিলেন, তখন তাঁর ‘সেলিব্রিটিদের নিয়ে কার্নিভালে নাচা’র অমানবিক কাজকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ঘৃণা করেছে। এর বিপরীতে, বিজেপি বিধায়ক ও সাংসদরা ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দিতে মাঠে ছিলেন। তাই, তিনি এখন আতঙ্কের বোতাম টিপেছেন এবং তাঁর ‘বিশেষ সম্প্রদায়ের’ গুন্ডাদের লেলিয়ে দিয়ে বিজেপি সাংসদ ও বিধায়কদের ওপর আক্রমণ করার জন্য উসকে দিয়েছেন, যাতে ত্রাণ কার্যক্রমে বাধা দেওয়া যায়… মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনি বিজেপিকে ভয় দেখাতে পারবেন না…”
বিজেপি সাংসদ সুকান্ত মজুমদারও অভিযোগ করেন যে “মমতা-পুলিশের উপস্থিতিতে” এই হামলা হয়েছে। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন:
“ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি উত্তরবঙ্গে মারাত্মক ধ্বংস এবং বহু মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরেও গতকাল রেড রোডের কার্নিভাল মঞ্চে উৎসব করতে দেখা গেছে, তিনি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের কর্মী ও নেতাদের কতটা ভয় পেয়েছেন, যারা গতকাল থেকে মাঠে নিরলসভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন… গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত, বাংলার মানুষ আপনার নৃশংসতার প্রতিটি অনৈতিক ও অমানবিক কাজের শাস্তি দেবে। লজ্জা!”
তৃণমূলের পালটা সাফাই ও অন্তর্নিহিত কারণ
তৃণমূলের আইটি সেলের প্রধান দেবাংশু ভট্টাচার্য্য এই হামলার দায় অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, “সেখানে কোনো দলীয় পতাকা ছিল না। এটা ছিল সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যদি কেউ এই লাইন লিখতে চান যে যারা হামলা করেছে তারা তৃণমূলের সৈনিক, তবে সেটা তাদের ইচ্ছা।”
তবে এই হামলার নেপথ্যে অন্য একটি উদ্দেশ্যমূলক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত মিলেছে। নাগরাকাটার যে ভিড় বিজেপি সাংসদদের ধাওয়া করেছিল, তাদের বক্তব্য হলো তারা বার বার এই অঞ্চল থেকে বিজেপিকেই নির্বাচিত করে থাকে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের দুর্গত হতে হচ্ছে। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, নাগরাকাটার ওই দুর্গতদের পরিধান দেখে বন্যা-বিধ্বস্ত মানুষ মনে হয়নি, বরং পাশের প্লাবিত অঞ্চল ধূপগুড়ির মানুষেরা সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন যে বন্যায় তাঁদের থাকা, খাওয়া এবং পরনের ব্যবস্থা সমস্ত কিছু নষ্ট হয়েছে, তবুও সামান্য ত্রিপল টুকুও পরিবার পিছু প্রাপ্ত হয়নি ।
অতএব, বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ যে হামলার নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা আরও জোরদার হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এই হামলাকারীরা প্রকৃত বন্যা-বিধ্বস্ত মানুষ নন, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিজেপির ত্রাণ কার্যক্রম আটকাতে চেয়েছিল। এই কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্রদের এই বিষয়ে দেওয়া সাফাই ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও প্রশাসনিক তৎপরতা
জলপাইগুড়ি জেলার জেলা পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে যাতে আর কোনো ধরনের সহিংসতা না ঘটে।” পুলিশ একটি মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে।
এই হামলার ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটল যখন পশ্চিমবাংলায় প্রবল বৃষ্টি এবং ভূমিধসের কারণে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং এবং কালিম্পং সহ একাধিক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন যে সরকার সক্রিয় এবং এনডিআরএফ ও এসডিআরএফের দলগুলি উদ্ধার ও ত্রাণ কার্য চালাচ্ছে। তবে এই ঘটনা রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনের আগে বন্যা ত্রাণ নিয়ে রাজনৈতিক সংঘাতকে আরও তীব্র করে তুলবে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।